আইনি লড়াইয়ে চাকরি ফিরে পেলেন কুলাউড়ার প্রভাষক মোতাহের

News & Event

সিলেট ব্যুরো:

দীর্ঘ আইনি লড়াইয়ে মৌলভীবাজার জেলার কুলাউড়ার এমএ গণি আদর্শ কলেজের প্রভাষক মোহাম্মদ মোতাহের হোসেন চাকরি ফিরে পেয়েছেন। উচ্চ আদালতের রায়ে তাঁকে স্বপদে বহাল করা হয়।

মৌলভীবাজার জেলার কুলাউড়ার ইউছুফ-গণি আদর্শ কলেজ(পরিবর্তিত নাম- এম.এ.গণি আদর্শ কলেজ) এর গভর্ণিংবডি কর্তৃক প্রভাষক মোতাহের হোসেনকে বহিস্কার করা হয়। বহিষ্কারের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে রিট করলে অধ্যাাপক মোতাহের হোসেনের পক্ষে রায় দেয়া হয়। রায়ে কলেজটির বহিষ্কৃত প্রভাষক মোহাম্মদ মোতাহের হোসেনের বিরুদ্ধে কলেজ গভর্নিংবডির বহিষ্কারাদেশ সম্পুর্ণ অবৈধ এবং ক্ষমতার অপব্যবহার উল্লেখ করে আদেশ প্রাপ্তির ৭কার্য দিবসের মধ্যে তাঁেক চাকুরিতে স্বসম্মানে পূনর্বহালেরও নির্দেশ দিয়েছেন উচ্চ আদালত।

গত ২০ আগস্ট মামলাটির দীর্ঘ সাত পৃষ্ঠার এ পূর্ণাঙ্গ রায় উচ্চ আদালত কর্তৃক প্রকাশিত হয়। এর আগে গত ১৯ নভেম্বর ২১০৯ ও ৪ ডিসেম্বর ২০১৯ রিট পিটিশনের উপর দীর্ঘ শুনানি হয়। ৭ জানুয়ারি হাইকাের্টের বিজ্ঞ বিচারপতি এম এনায়েতুর রহিম এবং বিজ্ঞ বিচারপতি মোঃ মুস্তাফিজুর রহমানের যৌথ ব্যাঞ্চ মামলাটির চুড়ান্ত রায় ঘোষণা করেন।

রিটকারী প্রভাষক মোহাম্মদ মোতাহের হোসেনের পক্ষে মামলাটি পরিচালনা করেন বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট বার কাউন্সিলের সভাপতি সিনিয়র আইনজীবি এডভোকেট এ.এম.আমিন উদ্দিন ও এডভোকেট মুশফিকু রহিম। আসামি পক্ষের ইউছুফ-গণি আদর্শ কলেজের গভর্ণিংবডির সভাপতি এবং সম্পাদক/অধ্যক্ষের পক্ষে আইনজীবি ছিলেন এডভোকেট শেখ জুলফিকার বুলবুল। রাষ্ট্র পক্ষে কোশলী ছিলেন অমিত তালুকদার ডিএজি। রায়ে আদেশ প্রাপ্তি ৭ কার্যদিবসের মধ্যে প্রভাষক মোহাম্মদ মোতাহের হোসেনকে চাকুরিতে পুনর্বহালের জন্য কলেজের অধ্যক্ষকে নির্দেশ প্রদান করেছেন হাইকোর্ট।

মূল ঘটনা :

২০১২সালে সহকারী অধ্যাপক পদে পদোন্নতির জন্য আবেদন করেন প্রভাষক মোতাহের হোসেন। আর এ থেকেইে বিরোধর মূল সূত্রপাত। কলেজ প্রতিষ্ঠাতার ভাতিজা এ.এন.এম.আলম ও ভাতিজি জামাতা শাহ আলম সরকার, মমদুদ হোসেন ও দিলিপ চন্দ্র দাসসহ ৪ জন স্থানীয় সহকর্মী বিরোধীতা শুরু করেন। প্রভাষক মোতাহের হোসেনের পদোন্নতি ঠেকানোর কোনো উপায় না পেয়ে তাদের আজ্ঞাবহ গভর্ণিংবডিকে দিয়ে সে সময় থেকে বার বার মিথ্যা অভিযোগ তুলে কলেজচ্যুত করার চেষ্টা শুরু করেন। উল্লেখিত সহকর্মীদের আক্রোশের স্বীকার ও তাদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে প্রতিষ্ঠানের গভর্ণিংবডি সম্পূর্ণ ইচ্ছাকৃতভাবে কতিপয় মিথ্যা অভিযোগের ভিত্তিতে এবং অনৈতিক ও বিধি বহির্ভূতভাবে ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে সাময়িক বহিষ্কার করে। ২০১৫ সালের মার্চ হতে পূর্ণ বহিষ্কার করে বেতন ও সকল প্রকার ভাতা সম্পূর্ণ বন্ধ করে দিয়ে প্রভাষক মোতাহের হোসেনকে মানবেতর ও দুর্বিসহ জীবনে ঠেলে দেয় কলেজ গভর্ণিং বডি।

গভর্ণিংবডির অভিযোগের প্রেক্ষিতে ২০১৫ সালের ২৭ অক্টোবর মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড সিলেট এর আপীল এন্ড আব্রীট্রেশন কমিটির সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় প্রভাষক মোতাহের হোসেনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন ও তদন্ত প্রতিবেদন সন্দেহজনক প্রতিয়মান হলে অভিযোগ সমুহের অধিকতর তদন্তের জন্য মৌলভীবাজার সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ ড. ফজলুল আলীকে আহ্বায়ক এবং মৌলভীবাজারের জেলা শিক্ষা অফিসার এ.এস.এম.আব্দুল ওয়াদুদ ও মৌলভীবাজার সরকারি মহিলা কলেজের সহযোগী অধ্যাপক শাহ আব্দুল ওয়াদুকে দিয়ে তদন্ত কমিটি গঠন করেন সিলেট শিক্ষা বোর্ড।

ওই কমিটির তদন্তে প্রভাষক মোতাহের এর উপর আনীত অভিযোগসমুহ সম্পূর্ণই মিথ্যা প্রমাণিত হয়। প্রতিবেদনে তদন্ত কমিটি তাঁকে চাকুরীতে পূনর্বহালেরও সুপারিশ করেন। পরবর্তীতে ২০১৭ সালের ১ মার্চ বোর্ডের আপিল এন্ড আব্রীট্রেশন কমিটির সভায় উভয় পক্ষের উপস্থিতিতে প্রভাষক মোতাহের হোসেনকে অভিযোগের দায় হতে অব্যাহতি প্রদান করে চাকুরিতে পূনর্বহালের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন সিলেট শিক্ষা বোর্ডের আপীল এন্ড আব্রীট্রেশন কমিটি।

সিদ্ধান্তের প্রেক্ষিতে ২০১৭ সালের ১২ মার্চ বোর্ডের সচিব বহিষ্কৃত প্রভাষক মোতাহের হোসেনকে চাকুরীতে পূনর্বহালের নির্দেশ সম্বলিত পত্র ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ, ইউছুফ-গণি আদর্শ কলেজ প্রেরণ করলে তিনি পরপর দু’দফা যোগদান পত্র নিয়ে গেলেও কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ তাঁর যোগদান পত্র গ্রহণে সম্পূর্ণ অস্বীকৃিত জানান। তাঁকে পূনর্বার কলেজের যেতে নিষেধ করেন। বিষয়টি তিনি মহাপরিচালক, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তর, ঢাকা এবং মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড সিলেট এর চেয়ারম্যানকে আবেদন করে অবহিত করেন।

২০১৭ সালের ৬ জুন সিলেট শিক্ষা বোর্ডের আপীল এন্ড আব্রীট্রেশন কমিটির সিদ্ধান্ত কার্যকর করার জন্য ১৫দিনের সময় বেধে দিয়ে আরও একটি চিঠি সচিব, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড সিলেট কর্তৃক ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ,ইউছুফ-গণি আদর্শ কলেজকে প্রেরণ করেন। পত্রের মর্মনুযায়ী ২০১৭ সালের ১২ জুন প্রভাষক মোতাহের হোসেন আবারও কলেজে যোগদান পত্র নিয়ে গেলে কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ পূর্বের ন্যায় তা গ্রহনে আস্বীকৃতি জানান।

যাবতীয় বিষয়ে ২০১৭ সালের ১৯ জুন তিনি আবেদন করে সিলেট শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যানকে অবহিত করেন। এখানেই শেষ নয়, প্রভাষক মোতাহের হোসেনের আবেদনের প্রেক্ষিতে সিলেট শিক্ষা বোর্ডের আদেশ বাস্তাবায়ন করার জন্য মৌলভীবাজারের তৎকালীন জেলা প্রশাসক তোফায়েল ইসলাম এর নির্দেশে ২০১৭ সালের ২০ সেপ্টেম্বর কুলাউড়া উপজেলা নির্বাহি কর্মকর্তা চৌধুরী গোলাম রাব্বি কলেজের অধ্যক্ষকে পত্র প্রেরণ করেন। কিন্তু কলেজের গভর্ণিং বডি জেলা প্রশাসকের নির্দেশকেও অবজ্ঞা করেন।

ইউছুফ-গণি আদর্শ কলেজ কর্তৃক মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড সিলেট এর আদেশ বারবার উপেক্ষিত হওয়ায় এবং অবশেষে জেলা প্রশাসক মৌলভীবাজারের অদেশ উপেক্ষিত হওয়ায় বাধ্য হয়েই প্রভাষক মোতাহের হোসেন ২০১৭ সালের ১০ জুলাই হাইকোর্টে রিট পিটিশন ৯৬২০/২০১৭ দাখিল করেন।

>রিটের প্রেক্ষিতে মহামান্য হাইকোর্ট এর বিজ্ঞ বিচারপতি জোবায়ের রহমান চৌধুরী ও মোঃ ইকবাল কবির এর যৌথ বেঞ্চ ইউছুফ-গণি আদর্শ কলেজের গভর্ণিংবডি কর্তৃক প্রভাষক মোতাহের হোসেনেকে চাকুরিতে পূনর্বহালের আদেশ লংঘন কেন অবৈধ হবেনা এবং কেন এরকম বেআইনী কাজের জন্য গভর্ণিংবডির বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহন করা যাবেনা তার কারণ দর্শানোর জন্য দু’সপ্তাহের রুলনিশির আদেশ প্রদান করেন।

পর পর দু’দফা রিটের চুড়ান্ত শুনানি শেষে গত ৭ জানুয়ারি মহামান্য হাইকোর্টের বিজ্ঞ বিচারক মন্ডলী বিচারপতি এম এনায়েতুর রহিম এবং বিজ্ঞ বিচারপতি মোঃ মুস্তাফিজুর রহমানের যৌথ ব্যাঞ্চ মামলাটির চুড়ান্ত রায় ঘোষণা করেন। রায়ে আদেশ প্রাপ্তির ১ সপ্তাহের মধ্যে নিরপরাধ প্রভাষক মোহাম্মদ মোতাহের হোসেনের যোগদান পত্র গ্রহণ করে চাকুরিতে যথাযথ পূনর্বহালের আদেশ প্রদান করেন।

২৪ আগস্ট মহামান্য হাইকোর্ট এর রায় কার্যকর করার আদেশ সম্বলিত পত্র হাইকোর্ট কর্তৃক যথাক্রমে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের ডিজি, সিলেট শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান ও সচিব এবং ইউছুফ-গণি আদর্শ কলেজের গভর্ণিংবডির সভাপতি ও অধ্যক্ষ বরাবরে প্রেরণ করা হয়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *