প্রতিটি মানুষের উচিত তার অবস্থানের উৎস, বর্তমান কার্য ও চূড়ান্ত পরিণতির হিসাব মিলিয়ে নেওয়া। সেই সঙ্গে একান্ত আবর্জনা আমরা যেন হয়ে না যাই। যতটুকু সাধ্য ও সামর্থ্য আমাদের রয়েছে তাই দিয়ে যেন বস্তুর চেয়ে অধিক কিছু রচনা বা সৃষ্টি করে যাই, যা অবিনশ্বর এবং সবসময়ের জন্য যা আমাদের প্রতি প্রতিদানের উপহার পাঠাতে পারে। আমরা বস্তুই হয়ে যাই আর প্রকৃত দেহের অবয়বেই থাকি না কেন, ওই প্রতিদান তখন আমাদের অসীম কাজে আসবে
মানুষের কোনো কাজে আসে না অথবা আপাতত কাজে লাগানোর কোনো উপায়ও জানা নেই, এমন বস্তুসামগ্রীকেই আমরা আবর্জনা বলে থাকি। প্রাণিজ উদ্ভিজ্জ ও রাসায়নিক পরিত্যাজ্য বা বর্জ্য উপাদানগুলো আবর্জনা বলে পরিগণিত। রাসায়নিক ও পারমাণবিক বর্জ্যগুলোকে সর্বকালীন আবর্জনা হিসেবে ভাবা হয়। জীব বর্জ্যগুলোর সুদূরপ্রসারী বহুমুখী উপকারিতা থাকায় বিজ্ঞানীরা এসবকে একেবারে মূল্যহীন বলতে নারাজ। বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে পরিবেশ ও জীবকুলের ভারসাম্য এবং জীবনরক্ষার জন্য এদের উপকারিতার সীমা নেই। সাধারণভাবে আবর্জনা বলতে আমরা অপ্রয়োজনীয় দ্রব্য ও উচ্ছিষ্টকে বুঝে থাকি। তবু এর সম্পর্কে আর একটু জানা যাক। নিজস্ব প্রয়োজনে জীবের প্রতিটি অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ও আকার-আকৃতির গঠন তৈরি হয়েছে। যার প্রতিটির কর্ম ও সুবিধার সীমা নির্দিষ্ট। যেমন পাতা অনন্তকাল উদ্ভিদ দেহের জন্য শোভা ও উপকার বয়ে না এনে কিছুকাল পর বোঝা হয়ে দাঁড়ায়। প্রাণীদেহের খাদ্যসার শোষিত, গৃহীত খাদ্য এক সময় বোঝা হয়ে যায়। এভাবে কিছু অঙ্গ দ্রব্য ও বস্তু প্রয়োজন ফুরানোর পর আবর্জনা বলে পরিগণিত হয়। যে সবুজ ঘাস, লতাপাতার সমাহার দৃষ্টিকে কৃতজ্ঞতাপাশে আবদ্ধ করে, তারই চূড়ান্ত দশা অর্থাৎ মৃত্যুর পর ক্ষয়িষ্ণু ও কালচে ধূসর বর্ণ মানুষের চোখে পীড়াদায়ক ও অপ্রয়োজনীয় বলে মনে হয়। পৃথিবীর প্রতিটি বস্তুই ক্রমে ধ্বংসশীল। (ড. শাহজাহান তপন চৌধুরী, নিউক্লীয় পদার্থবিদ্যা পরিচিতি, বাংলা একাডেমি, পৃ. ২৫১)। কারও বা এ প্রক্রিয়া দ্রুততর হওয়ায় সহজে চোখে পড়ে। কারোটা গোপনে বা দীর্ঘ সময় ধরে ঘটায় সহজে বোঝা যায় না। ধ্বংসশীল জীব, জড় ও শক্তিসম্পন্ন উপাদানের দিকে মনোযোগ দিলে পৃথিবীর নশ্বরতা ও মেকিময়তা প্রমাণিত হয়। ছোট্ট যে তৃণ, যার জন্ম হয়তো কোনো সূক্ষ্ম দানা থেকে, সে তার চিকন-চিরল ডাল ও পাতা বাতাসে নেড়ে নেড়ে কৃতজ্ঞতা ও সৌন্দর্য প্রকাশ করছে পৃথিবীর। যার জন্য গবাদিপশু ও ভূমি পেয়েছিল খাদ্য এবং ভাঙনের হাত থেকে রক্ষা। এ তুচ্ছ তৃণও আর হেলে-দুলে বাতাসে নাচার ক্ষমতা রাখবে না। এর শাখা ও পাতা বা অঙ্গ নির্দিষ্ট সময়ের পর মৃত কালচে আবর্জনা হয়ে যায়। বিস্তীর্ণ তৃণভূমি রয়েছে ‘সাভানা’ প্রভৃতি বিশ্বের তৃণ অঞ্চলে। এখানে দাবানলের মতো অগ্নিকাণ্ডের খবর আমরা জানি। শুষ্ক মৌসুমে মাটিতে ছাই-সার দিতে কৃত্রিমভাবেও তৃণাঞ্চলে আগুন দেওয়া হয়। অতি কষ্টসহিষ্ণু এ তৃণ বা ঘাসের ওপরের অংশ ছাই হয়ে গেলেও মাটির নিম্নাংশ ঠিকই বেঁচে যায় অসীম কুদরতে। পরবর্তী অনুকূল আবহাওয়ায় এ থেকে আবার তৃণভূমির জন্ম হয়। এ সমুদয় তথ্যের মধ্যে আল্লাহর অসীম রহস্যের দিকনির্দেশনা রয়েছে। তাই সূরা আলার ৪ ও ৫নং আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেনÑ ‘এবং যিনি ভূচর-খাদ্য তৃণ উৎপাদন করেছেন। অতঃপর পরিণত করেছেন তাকে কালো আবর্জনায়।’
তৃণগুলো সবুজ বা সবুজাভ। আর তার থেকে উৎপন্ন আবর্জনা কালো। এই একই বিষয়ের দুটি দশায় দুই রকমের বর্ণ নিয়ে একটু কথা বলা যাক। ঘাসের পাতার কোষের মধ্যে থাকে সবুজ রঙের কোটারূপ ক্লোরোপ্লাস্টিড। এখানে থাকে সবুজ বর্ণকণিকা ক্লোরোফিল। জীবন্ত কোষে এরা থাকে বলেই পাতাকে সবুজ, সজীব ও উজ্জ্বল দেখায়। ক্লোরোপ্লাস্টে সূর্যের আলোর সাহায্যে ক্লোরোফিল নামক বর্ণকণিকার জন্ম হয়। আলো না পৌঁছালে ওই বর্ণ আর উৎপন্ন হয় না; তাই পাতা সবুজতা হারিয়ে অন্য বর্ণের হয়ে যেতে থাকে। তাই ইট, মাটি বা অন্য কিছু দিয়ে চাপা দিয়ে রাখলে গাছপালা বা ঘাসের পাতা সাদাটে বা সবুজ ছাড়া অন্য বর্ণ ধারণ করে। ক্লোরোপ্লাস্টের বিভাজনেও আলো নামক শক্তির প্রয়োজন হয়। সূর্যের আলো অথবা প্রয়োজনীয় আলোর কণিকারা খোদায়ি নির্দেশ বিশেষ। এরা সুনির্দিষ্ট নিয়ম ও শৃঙ্খলা মেনে যথাযথ বস্তুতে পড়লে যথাযথ কাজ সম্পন্ন করিয়ে নেয়।
তৃণ সজীব থাকে তার ভেতর এবং বাইরের শক্তি বা নির্দেশ কার্যকর থাকলে এসবই ঠিক তাকে জীবদ্দশায়। আর মৃত্যু মানে তার অলৌকিক অসাধারণ নিয়মশৃঙ্খলার দারুণ ব্যাঘাত। এটা ঘটে গেলে (ছিঁড়ে নেওয়া, পুড়ে যাওয়া, ডুবে যাওয়া অথবা বয়সজনিত মৃত্যুর দ্বারা) আর সবুজ বর্ণ উৎপাদনের নিয়ম কার্যকর থাকে না। তৃণদেহের কোষের অন্য অঙ্গাণুও তার রাসায়নিক উপাদানগুলোর জীবনস্পন্দন দেখানোর উপযুক্ত থাকতে পারে না। দেহের যাবতীয় অঙ্গ আস্তে আস্তে বিশ্লেষিত হয়ে কার্বন, নাইট্রোজেন ইত্যাদিতে পরিণত হতে থাকে। উদ্ভিদদেহের প্রধানত কাঠামো হলো কার্বন। এটা কালচে বর্ণের। কয়লা, ধোঁয়া, চুল্লির কালি এসবই কার্বন। তাই যথেষ্ট পরিমাণে কার্বনযুক্ত মৃত তৃণের অংশ কালচে বর্ণের আবর্জনা হয়ে যায়। এরা তখন এত হালকা হয় যে, ধুলো, এমনকি এদের ধোঁয়াও বলা যেতে পারে। জীবন এবং মৃত্যুর বর্ণময় এ উপমা দিয়ে আল্লাহ মানুষকে তার পরিণতির দিকে ভাবতে তাগিদ দিয়েছেন। তাই সূরা কাহফের ৪৫নং আয়াতে আল্লাহ এরশাদ করেছেনÑ ‘তাদের কাছে পার্থিব জীবনের উপমা বর্ণনা করুন। তা পানির মতো, যা আমি আকাশ থেকে বর্ষণ করি। অতঃপর এর সংমিশ্রণে শ্যামল-সবুজ ভূমিজ লতাপাতা নির্গত হয়; অতঃপর তা এমন শুষ্ক চূর্ণবিচূর্ণ হয় যে, বাতাসে উড়ে যায়। আল্লাহ এসব কিছুর ওপর শক্তিমান।’
তেমনি সূরা আল হাদিদের ২০নং আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেনÑ ‘তোমরা জেনে রাখো, পার্থিব জীবন তো ক্রীড়া-কৌতুক, জাঁকজমক, পারস্পরিক অহমিকা এবং ধনৈশ্বর্য ও সন্তান-সন্ততির প্রাচুর্য লাভে প্রতিযোগিতা ছাড়া আর কিছু নয়। তার উপমা বৃষ্টি, যার দ্বারা উৎপন্ন শস্য-সম্ভার কৃষকদের চমৎকৃত করে, তারপর তা শুকিয়ে যায়, ফলে তুমি তা পীতবর্ণ দেখতে পাও, এরপর তা খুড়কুটায় পরিণত হয়।’
আমরা জানি, পানিচক্রের আশ্চর্য উপায়ে আল্লাহপাক পৃথিবীতে সুজলা-সুফলা শস্য-শ্যামলা করে তোলেন। বৃষ্টির তথা পানির মাধ্যমেই জীবনের উদ্ভব, বিকাশ ও প্রবাহ অব্যাহত থাকে। দয়া ও করুণার দান ওই পানির এ আবর্তন যদি কোনো কারণে তুলে নেওয়া হয়, পৃথিবীর সব শক্তি মিলে সামান্য কিছু জীবের জীবিকার সংস্থানও করতে পারবে না। বিজ্ঞান নতুন কিছু সৃষ্টি করে না। আল্লাহ তায়ালার দিয়ে রাখা নিয়মগুলোকে প্রয়োগ করে মাত্র। তুচ্ছ কিছু উপকারিতা খুঁজে নিয়ে নিজেদের মহান করতে চায় বিজ্ঞানীরা। আল্লাহর কোটি কোটি নেয়ামত সর্বক্ষণ অনায়াসে হাতের মুঠোয় আসে বলেই এসবের গুরুত্ব আমরা বুঝতে পারি না। নিজেদের সৃষ্ট অথবা সংমিশ্রিত দ্রব্য ও যন্ত্র নিয়েই সব আকাক্সক্ষা পূরণের অসম প্রতিযোগিতা মানুষের। তাই প্রকৃত সত্য থেকে অনেক সময় মানুষকে ফিরিয়ে রাখে দুনিয়াবি জ্ঞান-অনুসন্ধান। তৃণ ও আবর্জনা থেকে তাই আমাদের শিক্ষা নেওয়া উচিত। এর চেয়ে বোধ করি আর সব জীব ও উদ্ভিদকেই অধিক গুরুত্বপূর্ণ মনে করা হয়। অথচ সবাইকে চূড়ান্ত পরিণতি মেনে এক সময় আবর্জনা হয়ে যেতে হবে। উদ্ভিদ পাতা ও বাকল ফেলে দেয়। সাপ ও সরীসৃপ খোলস ছাড়ে। এ পরিত্যাগের মধ্যে এক নির্মম সত্য এই যে, সবাইকে সবটুকু ছেড়ে দিয়ে যেতে হবে। এ আকর্ষণীয় বর্ণময় পৃথিবীর লোভ-লালসা সহজে যেন ত্যাগ করা যায়, তার নানা উপায় ও উপকরণ সন্ধান করতে বলেছেন আল্লাহ তায়ালা।
প্রতিটি মানুষের উচিত তার অবস্থানের উৎস, বর্তমান কার্য ও চূড়ান্ত পরিণতির হিসাব মিলিয়ে নেওয়া। সেই সঙ্গে একান্ত আবর্জনা আমরা যেন হয়ে না যাই। যতটুকু সাধ্য ও সামর্থ্য আমাদের রয়েছে তাই দিয়ে যেন বস্তুর চেয়ে অধিক কিছু রচনা বা সৃষ্টি করে যাই, যা অবিনশ্বর এবং সবসময়ের জন্য যা আমাদের প্রতি প্রতিদানের উপহার পাঠাতে পারে। আমরা বস্তুই হয়ে যাই আর প্রকৃত দেহের অবয়বেই থাকি না কেন, ওই প্রতিদান তখন আমাদের অসীম কাজে আসবে।
- মো. আজহারুল হক
মানুষের কোনো কাজে আসে না অথবা আপাতত কাজে লাগানোর কোনো উপায়ও জানা নেই, এমন বস্তুসামগ্রীকেই আমরা আবর্জনা বলে থাকি। প্রাণিজ উদ্ভিজ্জ ও রাসায়নিক পরিত্যাজ্য বা বর্জ্য উপাদানগুলো আবর্জনা বলে পরিগণিত। রাসায়নিক ও পারমাণবিক বর্জ্যগুলোকে সর্বকালীন আবর্জনা হিসেবে ভাবা হয়। জীব বর্জ্যগুলোর সুদূরপ্রসারী বহুমুখী উপকারিতা থাকায় বিজ্ঞানীরা এসবকে একেবারে মূল্যহীন বলতে নারাজ। বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে পরিবেশ ও জীবকুলের ভারসাম্য এবং জীবনরক্ষার জন্য এদের উপকারিতার সীমা নেই। সাধারণভাবে আবর্জনা বলতে আমরা অপ্রয়োজনীয় দ্রব্য ও উচ্ছিষ্টকে বুঝে থাকি। তবু এর সম্পর্কে আর একটু জানা যাক। নিজস্ব প্রয়োজনে জীবের প্রতিটি অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ও আকার-আকৃতির গঠন তৈরি হয়েছে। যার প্রতিটির কর্ম ও সুবিধার সীমা নির্দিষ্ট। যেমন পাতা অনন্তকাল উদ্ভিদ দেহের জন্য শোভা ও উপকার বয়ে না এনে কিছুকাল পর বোঝা হয়ে দাঁড়ায়। প্রাণীদেহের খাদ্যসার শোষিত, গৃহীত খাদ্য এক সময় বোঝা হয়ে যায়। এভাবে কিছু অঙ্গ দ্রব্য ও বস্তু প্রয়োজন ফুরানোর পর আবর্জনা বলে পরিগণিত হয়। যে সবুজ ঘাস, লতাপাতার সমাহার দৃষ্টিকে কৃতজ্ঞতাপাশে আবদ্ধ করে, তারই চূড়ান্ত দশা অর্থাৎ মৃত্যুর পর ক্ষয়িষ্ণু ও কালচে ধূসর বর্ণ মানুষের চোখে পীড়াদায়ক ও অপ্রয়োজনীয় বলে মনে হয়। পৃথিবীর প্রতিটি বস্তুই ক্রমে ধ্বংসশীল। (ড. শাহজাহান তপন চৌধুরী, নিউক্লীয় পদার্থবিদ্যা পরিচিতি, বাংলা একাডেমি, পৃ. ২৫১)। কারও বা এ প্রক্রিয়া দ্রুততর হওয়ায় সহজে চোখে পড়ে। কারোটা গোপনে বা দীর্ঘ সময় ধরে ঘটায় সহজে বোঝা যায় না। ধ্বংসশীল জীব, জড় ও শক্তিসম্পন্ন উপাদানের দিকে মনোযোগ দিলে পৃথিবীর নশ্বরতা ও মেকিময়তা প্রমাণিত হয়। ছোট্ট যে তৃণ, যার জন্ম হয়তো কোনো সূক্ষ্ম দানা থেকে, সে তার চিকন-চিরল ডাল ও পাতা বাতাসে নেড়ে নেড়ে কৃতজ্ঞতা ও সৌন্দর্য প্রকাশ করছে পৃথিবীর। যার জন্য গবাদিপশু ও ভূমি পেয়েছিল খাদ্য এবং ভাঙনের হাত থেকে রক্ষা। এ তুচ্ছ তৃণও আর হেলে-দুলে বাতাসে নাচার ক্ষমতা রাখবে না। এর শাখা ও পাতা বা অঙ্গ নির্দিষ্ট সময়ের পর মৃত কালচে আবর্জনা হয়ে যায়। বিস্তীর্ণ তৃণভূমি রয়েছে ‘সাভানা’ প্রভৃতি বিশ্বের তৃণ অঞ্চলে। এখানে দাবানলের মতো অগ্নিকাণ্ডের খবর আমরা জানি। শুষ্ক মৌসুমে মাটিতে ছাই-সার দিতে কৃত্রিমভাবেও তৃণাঞ্চলে আগুন দেওয়া হয়। অতি কষ্টসহিষ্ণু এ তৃণ বা ঘাসের ওপরের অংশ ছাই হয়ে গেলেও মাটির নিম্নাংশ ঠিকই বেঁচে যায় অসীম কুদরতে। পরবর্তী অনুকূল আবহাওয়ায় এ থেকে আবার তৃণভূমির জন্ম হয়। এ সমুদয় তথ্যের মধ্যে আল্লাহর অসীম রহস্যের দিকনির্দেশনা রয়েছে। তাই সূরা আলার ৪ ও ৫নং আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেনÑ ‘এবং যিনি ভূচর-খাদ্য তৃণ উৎপাদন করেছেন। অতঃপর পরিণত করেছেন তাকে কালো আবর্জনায়।’
তৃণগুলো সবুজ বা সবুজাভ। আর তার থেকে উৎপন্ন আবর্জনা কালো। এই একই বিষয়ের দুটি দশায় দুই রকমের বর্ণ নিয়ে একটু কথা বলা যাক। ঘাসের পাতার কোষের মধ্যে থাকে সবুজ রঙের কোটারূপ ক্লোরোপ্লাস্টিড। এখানে থাকে সবুজ বর্ণকণিকা ক্লোরোফিল। জীবন্ত কোষে এরা থাকে বলেই পাতাকে সবুজ, সজীব ও উজ্জ্বল দেখায়। ক্লোরোপ্লাস্টে সূর্যের আলোর সাহায্যে ক্লোরোফিল নামক বর্ণকণিকার জন্ম হয়। আলো না পৌঁছালে ওই বর্ণ আর উৎপন্ন হয় না; তাই পাতা সবুজতা হারিয়ে অন্য বর্ণের হয়ে যেতে থাকে। তাই ইট, মাটি বা অন্য কিছু দিয়ে চাপা দিয়ে রাখলে গাছপালা বা ঘাসের পাতা সাদাটে বা সবুজ ছাড়া অন্য বর্ণ ধারণ করে। ক্লোরোপ্লাস্টের বিভাজনেও আলো নামক শক্তির প্রয়োজন হয়। সূর্যের আলো অথবা প্রয়োজনীয় আলোর কণিকারা খোদায়ি নির্দেশ বিশেষ। এরা সুনির্দিষ্ট নিয়ম ও শৃঙ্খলা মেনে যথাযথ বস্তুতে পড়লে যথাযথ কাজ সম্পন্ন করিয়ে নেয়।
তৃণ সজীব থাকে তার ভেতর এবং বাইরের শক্তি বা নির্দেশ কার্যকর থাকলে এসবই ঠিক তাকে জীবদ্দশায়। আর মৃত্যু মানে তার অলৌকিক অসাধারণ নিয়মশৃঙ্খলার দারুণ ব্যাঘাত। এটা ঘটে গেলে (ছিঁড়ে নেওয়া, পুড়ে যাওয়া, ডুবে যাওয়া অথবা বয়সজনিত মৃত্যুর দ্বারা) আর সবুজ বর্ণ উৎপাদনের নিয়ম কার্যকর থাকে না। তৃণদেহের কোষের অন্য অঙ্গাণুও তার রাসায়নিক উপাদানগুলোর জীবনস্পন্দন দেখানোর উপযুক্ত থাকতে পারে না। দেহের যাবতীয় অঙ্গ আস্তে আস্তে বিশ্লেষিত হয়ে কার্বন, নাইট্রোজেন ইত্যাদিতে পরিণত হতে থাকে। উদ্ভিদদেহের প্রধানত কাঠামো হলো কার্বন। এটা কালচে বর্ণের। কয়লা, ধোঁয়া, চুল্লির কালি এসবই কার্বন। তাই যথেষ্ট পরিমাণে কার্বনযুক্ত মৃত তৃণের অংশ কালচে বর্ণের আবর্জনা হয়ে যায়। এরা তখন এত হালকা হয় যে, ধুলো, এমনকি এদের ধোঁয়াও বলা যেতে পারে। জীবন এবং মৃত্যুর বর্ণময় এ উপমা দিয়ে আল্লাহ মানুষকে তার পরিণতির দিকে ভাবতে তাগিদ দিয়েছেন। তাই সূরা কাহফের ৪৫নং আয়াতে আল্লাহ এরশাদ করেছেনÑ ‘তাদের কাছে পার্থিব জীবনের উপমা বর্ণনা করুন। তা পানির মতো, যা আমি আকাশ থেকে বর্ষণ করি। অতঃপর এর সংমিশ্রণে শ্যামল-সবুজ ভূমিজ লতাপাতা নির্গত হয়; অতঃপর তা এমন শুষ্ক চূর্ণবিচূর্ণ হয় যে, বাতাসে উড়ে যায়। আল্লাহ এসব কিছুর ওপর শক্তিমান।’
তেমনি সূরা আল হাদিদের ২০নং আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেনÑ ‘তোমরা জেনে রাখো, পার্থিব জীবন তো ক্রীড়া-কৌতুক, জাঁকজমক, পারস্পরিক অহমিকা এবং ধনৈশ্বর্য ও সন্তান-সন্ততির প্রাচুর্য লাভে প্রতিযোগিতা ছাড়া আর কিছু নয়। তার উপমা বৃষ্টি, যার দ্বারা উৎপন্ন শস্য-সম্ভার কৃষকদের চমৎকৃত করে, তারপর তা শুকিয়ে যায়, ফলে তুমি তা পীতবর্ণ দেখতে পাও, এরপর তা খুড়কুটায় পরিণত হয়।’
আমরা জানি, পানিচক্রের আশ্চর্য উপায়ে আল্লাহপাক পৃথিবীতে সুজলা-সুফলা শস্য-শ্যামলা করে তোলেন। বৃষ্টির তথা পানির মাধ্যমেই জীবনের উদ্ভব, বিকাশ ও প্রবাহ অব্যাহত থাকে। দয়া ও করুণার দান ওই পানির এ আবর্তন যদি কোনো কারণে তুলে নেওয়া হয়, পৃথিবীর সব শক্তি মিলে সামান্য কিছু জীবের জীবিকার সংস্থানও করতে পারবে না। বিজ্ঞান নতুন কিছু সৃষ্টি করে না। আল্লাহ তায়ালার দিয়ে রাখা নিয়মগুলোকে প্রয়োগ করে মাত্র। তুচ্ছ কিছু উপকারিতা খুঁজে নিয়ে নিজেদের মহান করতে চায় বিজ্ঞানীরা। আল্লাহর কোটি কোটি নেয়ামত সর্বক্ষণ অনায়াসে হাতের মুঠোয় আসে বলেই এসবের গুরুত্ব আমরা বুঝতে পারি না। নিজেদের সৃষ্ট অথবা সংমিশ্রিত দ্রব্য ও যন্ত্র নিয়েই সব আকাক্সক্ষা পূরণের অসম প্রতিযোগিতা মানুষের। তাই প্রকৃত সত্য থেকে অনেক সময় মানুষকে ফিরিয়ে রাখে দুনিয়াবি জ্ঞান-অনুসন্ধান। তৃণ ও আবর্জনা থেকে তাই আমাদের শিক্ষা নেওয়া উচিত। এর চেয়ে বোধ করি আর সব জীব ও উদ্ভিদকেই অধিক গুরুত্বপূর্ণ মনে করা হয়। অথচ সবাইকে চূড়ান্ত পরিণতি মেনে এক সময় আবর্জনা হয়ে যেতে হবে। উদ্ভিদ পাতা ও বাকল ফেলে দেয়। সাপ ও সরীসৃপ খোলস ছাড়ে। এ পরিত্যাগের মধ্যে এক নির্মম সত্য এই যে, সবাইকে সবটুকু ছেড়ে দিয়ে যেতে হবে। এ আকর্ষণীয় বর্ণময় পৃথিবীর লোভ-লালসা সহজে যেন ত্যাগ করা যায়, তার নানা উপায় ও উপকরণ সন্ধান করতে বলেছেন আল্লাহ তায়ালা।
প্রতিটি মানুষের উচিত তার অবস্থানের উৎস, বর্তমান কার্য ও চূড়ান্ত পরিণতির হিসাব মিলিয়ে নেওয়া। সেই সঙ্গে একান্ত আবর্জনা আমরা যেন হয়ে না যাই। যতটুকু সাধ্য ও সামর্থ্য আমাদের রয়েছে তাই দিয়ে যেন বস্তুর চেয়ে অধিক কিছু রচনা বা সৃষ্টি করে যাই, যা অবিনশ্বর এবং সবসময়ের জন্য যা আমাদের প্রতি প্রতিদানের উপহার পাঠাতে পারে। আমরা বস্তুই হয়ে যাই আর প্রকৃত দেহের অবয়বেই থাকি না কেন, ওই প্রতিদান তখন আমাদের অসীম কাজে আসবে।
- মো. আজহারুল হক
0 মন্তব্যসমূহ