Header Ads Widget


 

তরুণদের চাঁদাবাজ ও সন্ত্রাসী বানানোর দায় কার?

পাকিস্তান পর্ব থেকে মুক্তিযুদ্ধের পরবর্তী কয়েক বছর পর্যন্ত রাজনৈতিক নেতারা কমবেশি নিজেদের গণমানুষের নেতা ভাবতেন। তারা ভাবতেন, জনগণের শক্তিতেই সবাই শক্তিমান। মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী আওয়ামী লীগের সামনে তেমন রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ ছিল না তখন। এরপর ক্ষমতার রাজনীতি নতুন চেহারা নিয়ে আবির্ভূত হয়। একসময় বিএনপি আত্মপ্রকাশ করে। আওয়ামী লীগের আশ্রয়ে চলে যায় ছাত্রসমাজের প্রতিনিধি হিসাবে বহু আগে প্রতিষ্ঠিত স্বতন্ত্র ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগ। বিএনপি ছাত্রলীগের প্রতিপক্ষ হিসাবে দাঁড় করায় ছাত্রদল। জিয়াউর রহমান ‘রাজনীতিকে রাজনীতিকদের জন্য জটিল করে দেওয়ার’ ঘোষণা দিয়ে অস্ত্র ও অর্থ শক্তিতে বলীয়ান করে তোলেন ছাত্রদলের ছেলেদের। ছাত্রলীগও বসে থাকবে কেন? কেন্দ্রীয় নেতাদের প্রযোজনায় তারাও নিজ উজ্জ্বল ঐতিহ্য ভুলে লাঠিয়াল হয়ে যায় নিয়ন্ত্রণকারী দলের। এভাবে ছাত্রলীগ ও ছাত্রদলের নেতাকর্মীরা ছাত্রসমাজের প্রতিনিধিত্বের বদলে নিজ মূল দলের আজ্ঞাবহ হয়ে পড়ে। বলা যায়, রাজনৈতিক নেতারা রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের জন্য এভাবেই সম্ভাবনাময় তরুণদের দৃষ্টি থেকে সুন্দরের পথ দূরে সরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা অব্যাহত রাখলেন। এককালে বামধারার ছাত্রসংগঠন ছাত্র ইউনিয়ন জনপ্রিয়তার শীর্ষে ছিল। আওয়ামী লীগ থেকে বেরিয়ে এসে জাসদের নিয়ন্ত্রণে জাসদ ছাত্রলীগও সরব ছিল। এ দলের ভাঙনের মুখে জন্ম হয়েছিল বাসদ ছাত্রলীগের। সম্ভবত দল রাষ্ট্রক্ষমতায় না থাকায় এসব ছাত্র সংগঠন দুর্বল হয়ে পড়ে। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ক্ষমতায় এসে ছাত্র সমাজ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। কিন্তু শক্তিধর ছাত্রলীগ ও ছাত্রদলের মাঝখানে পড়ে সংগঠনটি কিছুকাল সক্রিয় থেকে পরে স্তিমিত হয়ে পড়ে। এরপর থেকে মূল দল সরকারে থাকলে যুগপৎ ছাত্রলীগ ও ছাত্রদল পেটোয়া বাহিনী হিসাবে দাবড়ে বেড়াতে শুরু করে। এমন বাস্তবতায় ছাত্ররাজনীতি থেকে মেধাবী ছাত্ররা নিজেদের সরিয়ে রাখে। রাজনৈতিক ক্ষমতাবান নেতারা নিজ নিজ ক্ষমতার ভিত শক্ত রাখতে ক্যাম্পাস দখলের জন্য নির্ভর করেন এসব ছাত্ররাজনীতির লাঠিয়ালদের ওপর। রক্তের স্বাদ পেলে বাঘ যেমন হিংস্র হয়ে যায়, তেমনই এসব ছাত্রনেতা চাঁদাবাজি ও টেন্ডারবাজির কাঁচা টাকার স্বাদ পেয়ে সাধারণ শিক্ষার্থীদের বন্ধু না হয়ে প্রভুরূপে প্রকাশ করতে থাকে ক্যাম্পাসে। ২০১৩ সালে সড়ক দুর্ঘটনার জেরে সড়ক অবরোধ করে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তুলেছিল স্কুলের কোমলমতি ছাত্রছাত্রীরা। যৌক্তিক দাবি মানার ক্ষেত্রে বরাবরের মতো সরকারি সিদ্ধান্তের ধীরে চলা নীতির কারণে অবস্থা বেশ জটিল হয়ে পড়েছিল। এ ধরনের আন্দোলনে ছাত্র সংগঠনগুলোর দায়িত্ব থাকে শিক্ষার্থীদের ন্যায়সংগত আন্দোলনের পাশে দাঁড়ানো। কিন্তু তখনো দেখেছি, সরকারকে রক্ষার জন্য ছাত্রলীগের কিছু কর্মী ঝাঁপিয়ে পড়েছিল সতীর্থ শিক্ষার্থীদের ওপর। তখন প্রথম প্রত্যক্ষ করি পেটোয়া ‘কমান্ড’ বাহিনী হিসাবে ‘হেলমেট বাহিনীর’ আবির্ভাব। এরপর ছাত্রদের কোটাবিরোধী আন্দোলন দমাতেও ছাত্রলীগের কিছু কর্মী আন্দোলনকারী ছাত্রদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। নিজ মূল দলের লাঠিয়াল হিসাবে এই বাহিনীটি এভাবেই বোধহয় প্রতিষ্ঠা পেয়ে যায়। তাই সাম্প্রতিক ঢাকা কলেজ-নিউমার্কেট তাণ্ডবে আবার হেলমেট বাহিনীকে মাঠে পাই। কাগজে দেখলাম, গোয়েন্দা তথ্যে এদের মুখোশ উন্মোচিত হয়েছে। এরা ঢাকা কলেজকেন্দ্রিক ছাত্রলীগের ‘কমান্ডো’-যারা প্রকাশ্যে কুপিয়ে হত্যা করেছে অসহায় নাহিদকে। গ্রেফতারও হয়েছে এদের কয়েকজন। নিউমার্কেট-কাণ্ডের আগেও ঢাকা কলেজের ছাত্রলীগ পরিচয়ের ছাত্ররা চাঁদাবাজি করতে গিয়ে নিউমার্কেটে সন্ত্রাস ছড়িয়েছে। নিজেদের মধ্যেও অনেকবার মারামারি করেছে তারা। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে-এমন অধঃপতন কেন? ঢাকা কলেজের সাবেক ছাত্র হিসাবে আমার সামনে অনেক প্রশ্ন চলে এসেছে। সত্তরের দশকের শেষদিকে আমি ঢাকা কলেজের ছাত্র ছিলাম। সেসময় অসুস্থ ছাত্ররাজনীতি প্রবেশ করতে পারেনি ঢাকা কলেজে। সারা দেশের মেধাবী ফলাফল করা ছাত্রদের সমাবেশ ঘটত ঢাকা কলেজ ও নটর ডেম কলেজে। আমার মনে পড়ে, ১৯৭৬ সালের দিকে ঢাকা কলেজে ছাত্ররাজনীতি শুরুর একটি পাঁয়তারা চলছিল। একজন সিনিয়র ছাত্র নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য নিজেকে শানাচ্ছিলেন। দু-একটি ছোটখাটো ঝামেলাও তৈরি করেছিলেন তিনি। ভূগোল বিভাগে তখন একজন ব্যক্তিত্বসম্পন্ন সাহসী জনপ্রিয় ম্যাডাম ছিলেন। এক সকালে দোতলার করিডরে ম্যাডামের উচ্চকণ্ঠ শুনে এগিয়ে গেলাম। দেখলাম ম্যাডাম সেই ছাত্রের কলার চেপে ধরেছেন। বলছেন, পড়াশোনার খবর নেই নেতাগিরি করছ। আরেকদিন যদি রাজনীতির ঘোট পাকাতে দেখি তো দোতলা থেকে নিচে ছুড়ে ফেলব। এরপর থেকে নীরব হয়ে গিয়েছিলেন ছাত্রটি। এখন ভাবি, শিক্ষকের এমন শাসন এখনো চলমান থাকলে কতসংখ্যক রাজনীতির ‘বিবেকবান’ গুণী মানুষ ছাত্রের পাশে এসে দাঁড়াতেন। বরং নিন্দার ঝড় বইতে পারে শিক্ষকের বিরুদ্ধে। দ্রুতই তার হাতে ভুরুঙ্গামারি বা আরও দুর্গম কোনো অঞ্চলের কলেজে বদলির আদেশ চলে আসবে কি না, এ নিয়েও চিন্তিত হয়ে পড়বেন সংশ্লিষ্ট শিক্ষক। আমাদের সময়ে ঢাকা কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন খুরশীদ আলম চৌধুরী স্যার। অত্যন্ত নীতিবান দৃঢ়চেতা মানুষ। তিনি এসব বখে যাওয়া ছাত্ররাজনীতিকে প্রশ্রয় দেননি। ওই সময়ে হোস্টেলে সিট পাওয়া খুব কঠিন ছিল। ইন্টারভিউর কঠিন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে সাউথ হোস্টেলে সিট পেয়েছিলাম আমি। নষ্ট রাজনীতির কোনো ছোঁয়া আমরা হোস্টেলে দেখিনি তখন। এভাবে মেধাবী ছাত্রদের চারণভূমি হওয়ায় ঢাকা কলেজ তার মেধাচর্চার গৌরব ধরে রাখতে পেরেছিল। এরপর কখন কোন পক্ষের শাসনামলে এদেশের সেয়ানা রাজনীতিকরা নিজের হাত শক্ত করতে অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মতো ঢাকা কলেজে ছাত্ররাজনীতির নামে ষণ্ডাতন্ত্র ঢুকিয়ে দিলেন তা নিশ্চিত করে বলতে পারব না। তবে পতন ঘটতে থাকল এই ঐতিহ্যবাহী কলেজের গৌরবের জায়গাটির। ঢাকা কলেজের সাবেক ছাত্র হিসাবে লজ্জায় অধোবদন হই, যখন নিউমার্কেটে কেনাকাটা করতে গিয়ে দোকানিদের আক্ষেপ শুনি। তারা বলেন ঢাকা কলেজের ছাত্রলীগ নামধারী ছাত্রদের দৌরাত্ম্যের কথা। ব্যবসায়ীদের ধারণা, ঢাকা কলেজের ছাত্রলীগ নামধারী চাঁদাবাজদের পেছনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগ ও কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগেরও প্রশ্রয় রয়েছে। মনে পড়ে, বেশ কয়েক বছর আগে নিউমার্কেটের এক শাড়ি ব্যবসায়ী বলছিলেন, বহুবার বলেও আমরা ব্যর্থ হয়েছি। পুলিশ প্রশাসন বা আওয়ামী লীগ কেউ ঢাকা কলেজের ছাত্রলীগ নামধারী সন্ত্রাসীদের শাসন করার জন্য আন্তরিকভাবে এগিয়ে আসেনি। আমরা অনেকটা জিম্মি হয়ে পড়েছি। এখন নিজেরাই নিজেদের রক্ষা করার কথা ভাবছি। এসব সন্ত্রাসীকে প্রতিহত করার জন্য আমাদেরও লাঠি হাতে নিতে হবে। আমি জানি না, সম্প্রতি ঢাকা কলেজের ছাত্রদের সঙ্গে নিউমার্কেটের দোকান কর্মচারীদের সংঘাতের সময় কর্মচারীদের ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ গড়ে তোলার এবং কখনো আগ্রাসী হয়ে আক্রমণ করার পেছনে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার যে দৃশ্য আমরা দেখেছি তা প্রতিরোধ দুর্গ গড়ার বাস্তবায়ন কি না! পাকিস্তান আমলে বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের কথা আমরা জানি। ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে সব গণতান্ত্রিক আন্দোলনে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা সামনের সারিতে ছিল। ছাত্রলীগ আওয়ামী লীগের চেয়ে পুরোনো প্রতিষ্ঠান। তাই ছাত্রদলের মতো ছাত্রলীগ নিজ মূল রাজনৈতিক দলের পকেট থেকে বেরোয়নি। ফলে সে যুগে ছাত্রলীগ কারও আজ্ঞাবহ ছিল না। বৃহত্তর জাতীয় প্রয়োজনেই ছাত্ররা ঝাঁপিয়ে পড়ত। তাই সে সময় ছাত্রনেতা ও কর্মীদের নৈতিকতার মান অতি উঁচুতে ছিল। সাধারণ মানুষের সমর্থন ছিল ছাত্র আন্দোলনের প্রতি। আইয়ুব খান এনএসএফ গঠন করে তার আজ্ঞাবহ ছাত্রদের হাতে অস্ত্র তুলে দিয়েছিলেন। কিন্তু এনএসএফের ছোবল বিষ ছড়াতে পারেনি সাধারণ ও রাজনীতি করা ছাত্রছাত্রীর মধ্যে। ছাত্ররাজনীতি কলুষিত হওয়ার পথ তৈরি হয় স্বাধীনতার পর থেকেই। ১৯৭২ সালে জাসদ গঠিত হওয়ার পর এ দলের ছত্রছায়ায় ছাত্রলীগ ভেঙে একটি অংশ হয়ে যায় জাসদ ছাত্রলীগ অপর অংশটি পরিচিত হয় মুজিববাদী ছাত্রলীগ নামে। পরে আবার জাসদ ভেঙে বাসদ আত্মপ্রকাশ করে। এ দলের ছায়ায় বাসদ ছাত্রলীগ মাথাচাড়া দেয়। এভাবে ছাত্ররাজনীতি নিজেদের স্বাতন্ত্র্য হারাতে থাকে। পরিণত হতে থাকে মূল দলের আজ্ঞাবহ সংগঠনে। এরপর ছাত্ররাজনীতির বড় স্খলন দেখা যায় ১৯৭৫-পরবর্তী সময়ে। সামরিক ছাউনি থেকে সৃষ্টি হওয়া দল বিএনপি সৃষ্টি করে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের। আওয়ামী লীগ নতুন প্রতিপক্ষকে মোকাবিলা করার জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দলীয় ছাত্রদের বিএনপির মতো করে লাঠিয়াল বানাতে থাকে। এভাবে নৈতিকতার স্খলন ঘটতে থাকে ক্যাম্পাসগুলোয়। ক্ষমতা আঁকড়ে থাকতে আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টি যার যার সময়ে বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ ক্যাম্পাস দখল করতে থাকে। শিক্ষার পরিবেশ ধ্বংস হওয়া আর শিক্ষার্থীদের অন্ধকারে তলিয়ে যাওয়া নিয়ে তেমন ভাবনা রাজনৈতিক নেতৃত্বের মধ্যে তেমন একটা দেখা যায়নি। প্রত্যেক দলই রাষ্ট্রক্ষমতায় থেকে ক্যাম্পসে দলীয় ছাত্রদের দাপট টিকিয়ে রাখার জন্য তাদের চাঁদাবাজ ও সন্ত্রাসী বানিয়েছে। ছাত্ররাজনীতির সব স্খলন তো ঘটেছে এমন ধারা পথপরিক্রমণের মাধ্যমে। আজ সব নৈরাজ্যের দায় অবশ্যই আমাদের ক্ষমতাপ্রিয় রাজনৈতিক দলের নেতাদের নিতে হবে। কোনো দলের নেতৃত্বই যেন নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারছেন না। দলীয় ছাত্রদের কাঁধে ভর দিয়েই যেন ক্ষমতায় টিকে থাকা তাদের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। অথচ এর চরম মূল্য দিতে হচ্ছে দেশবাসীকে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে বিবর্ণ করে ফেলা হচ্ছে। দলকানা নন এমন মেধাবী শিক্ষার্থী ও শিক্ষকরা চরম হতাশায় নিপতিত হচ্ছেন। এই বন্দিত্ব থেকে মুক্ত করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে আবার রৌদ্রকরোজ্জ্বল জীবনীশক্তি দান করতে পারেন প্রধানত রাজনৈতিক দলের নেতানেত্রীরাই। আমরা চাতক পাখির মতো তাদের করুণা পাওয়ার জন্য তাকিয়ে আছি। ক্ষমতাপ্রেমের চেয়ে দেশপ্রেমকে গুরুত্ব দিয়ে তারা যদি শিক্ষার্থীদের রাজনীতির নামে চাঁদাবাজ ও সন্ত্রাসী না বানিয়ে দেশপ্রেমিক বানাতে পারতেন তবে জাতির বৃহত্তর প্রয়োজনে এই ছাত্রশক্তিই সুস্থ ধারার রাজনৈতিক দলের পাশে এসে দাঁড়াত। এ কে এম শাহনাওয়াজ : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় shahnawaz7b@gmail.com

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ