রেস্টুরেন্ট ব্যবসা এবং বাংলাদেশ
বর্তমানে রেস্টুরেন্ট ব্যবসা একটি প্রবল সম্ভাবনাময় ব্যবসা। তবে বর্তমান দেখেই তো আর সিদ্ধান্তে আসা যায়না। এই খাতের ভবিষ্যতের উপরই নির্ভর করছে বর্তমানে এখানে ইনভেস্ট করা ঠিক হবে কিনা। আমাদের আজকের লেখাটা রেস্টুরেন্ট ব্যবসার বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ নিয়েই।
২০১০ কিংবা ২০১১ সালের দিকেও চট্টগ্রামের শপিং মলের উপর এর ফুড কোর্ট গুলো ই ছিল যেন মধ্যবিত্ত কিংব ছাত্র ছাত্রীদের আড্ডা কিংবা সবাই মিলে ভাল মন্দ খাওয়ার অন্যতম আকর্ষন। কিন্তু এরপর থেকেই হঠাৎ পুরো বাংলাদেশ জুড়ে রেস্টুরেন্ট এর সংখ্যা ক্রমাগত বৃদ্ধি পেতে থাকে।
২০২২ এ এসে যে পরিমান রেস্টুরেন্ট এর দেখা মিলে সেই ২০১০ কিংবা ঐ সময়টাতে এত চোখে পড়তোনা। ফেসবুক এর কল্যানে বর্তমানে এই সেক্টর যেন আরো উদীয়মান ও সম্ভাবনাময় খাত হয়ে উঠছে। প্রতিদিন ই নিত্য নতুন রেস্টুরেন্টের নাম শোনা যায় আজকাল। এর ফলে ব্যবসা বানিজ্যের যেমন প্রসার ঘটছে, তেমনি কর্মসংস্থান বাড়ছে, শেফ দের চাহিদা বাড়ছে। বলা চলে এই রেস্টুরেন্ট বিজনেস একটি সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিয়েছে।
এছাড়া কোন ফিজিক্যাল রেস্টুরেন্ট ছাড়াও শুধুমাত্র খাবার ডেলিভারি দিয়ে অনলাইন রেস্টুরেন্ট ব্যবসা করছেন অনেকে যেটা ‘ক্লাউড কিচেন’ নামে বেশ পরিচিত। গৃহিনীরাও এতে যুক্ত হচ্ছেন দিন দিন। এই রেস্টুরেন্ট বিজনেস এর উৎকর্ষ সাধনের পেছনে রয়েছে ফুডপান্ডা, হাংরি নাকি, ফুডফ্লেক্স, উবার ইটস (বর্তমানে তারা বাংলাদেশে ব্যবসা বন্ধ করে দিয়েছে), পাঠাও ফুডস এর মত কিছু ডেলিভারি প্রতিষ্ঠান।
আর ফেসবুকের নিজস্ব পেইজ এর মাধ্যমেও পাওয়া যাচ্ছে এই সুবিধা। ফুডপান্ডা বাংলাদেশের পরিচালক আমব্রিন রেজা জানান, ‘বিশ্বজুড়ে সবচেয়ে দ্রুতগতিতে পরিচিতি পাওয়া একটি উদ্যোগের নাম ফুডপান্ডা।
অনলাইন রেস্টুরেন্ট ব্যবসার উদ্যোগের ফলে যা হচ্ছে
অনলাইনে রেস্টুরেন্ট ব্যবসার উদ্যোগে রেস্তোরাঁ কর্তৃপক্ষ এবং গ্রাহক একস্থানে আসতে পেরেছেন। স্থানীয় রেস্তোরাঁ থেকে খাবার অর্ডার করার সুবিধা দিচ্ছে ফুডপান্ডা। এ ক্ষেত্রে গ্রাহকেরা ফুডপান্ডার ওয়েবসাইট এবং মোবাইল অ্যাপ্লিকেশনের মাধ্যমে পছন্দের রেস্তোরাঁয় খাবার ফরমায়েশ দিয়ে করতে পারছেন এবং নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে খাবার পেয়েও যাচ্ছেন।
বর্তমানে বিশ্বের ৪৫ টি দেশে সেবা দিচ্ছে জার্মান ভিত্তিক এই প্রতিষ্ঠান টি। প্রসারিত হচ্ছে চাকরির বাজার। শুধুমাত্র রেস্টুরেন্ট কে ঘিরেই নিত্যনতুন কন্সেপ্ট এর উদ্ভব হচ্ছে। যেমন রাজধানীর মোহাম্মদপুরে অবস্তিত ‘স্পাইসি সিক্স’ এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক রাশেদ কামাল বলেন, “আমাদের চেইনশপগুলোর মাঝে একটি বিষয় থাকবে- রেস্টুরেন্ট মানেই আমরা অনেকে বুঝি চার দেয়ালের মাঝে বন্দি। খোলামেলা জায়গায় সাধারণত রেস্টুরেন্ট থাকে না। আমরা চাচ্ছি চার দেয়ালে বন্দি না হয়ে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের মাঝে নিজেদের রেস্টুরেন্টটি সাজাতে।”
একই সাথে অন্যতম লাভজনক ব্যবসা হিসেবেও এই সেক্টরটি বেশ পরিচিতি পাচ্ছে। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রেস্টুরেন্ট আইডিয়া থেকেই গড়ে উঠছে বড় বড় হোটেল, মোটেল কিংবা রিসোর্ট। শুধু চাকরির ক্ষেত্র ই নয়, এই সেক্টরকে ঘিরে চাহিদা বাড়ছে,কন্টেন্ট মার্কেটিং কিংবা ডিজিটাল মার্কেটিং এর মত ক্ষেত্রগুলোর।
সাম্প্রতিককালে ফেসবুকের বিভিন্ন ফুড গ্রুপকে কেন্দ্র করে গ্রাহকদের ডিস্কাউন্ট দেয়ার মাধ্যমে এই রেস্টুরেন্ট ব্যবসার পরিধি যেন আরো সম্প্রসারিত হচ্ছে। এছাড়াও ফেসবুকে ‘চেক ইন’ অপশনটি এ প্রসার কে আরো তরান্বিত করছে। রেস্টুরেন্ট এর নাম লিখে সার্চ দিলেই চলে আসছে ঐ রেস্টুরেন্ট এ খাওয়া গ্রাহকদের লোভনীয় খাবারের ছবি আর রিভিউ। ইউটিউব এর মাধ্যমেও শুধুমাত্র খাবারের রিভিউ দিয়ে ভিডিও করেও একই সাথে অর্থোপার্জন করছেন ও পরিচিতি পাচ্ছেন অনেকেই।
সুতরাং সম্ভাবনার পাশাপাশি এই সেক্টরকে একটি প্রতিযোগিতাপূর্ণ সেক্টর ও অনায়াসে বলা যায়। গ্রাহক খাবারের মান নিয়ে যথেষ্ট সতর্ক। তাই বলা যায়,যারা রিজনেবল প্রাইজে ভাল মানের খাবার সার্ভ করতে পারছেন ও পর্যাপ্ত প্রমোশোন এর মাধ্যমে মার্কেটিং করছেন তারাই এই দৌড়ে এগিয়ে আছেন।
রেস্টুরেন্ট পাড়া
কোচিং পাড়া,কলেজ পাড়া,ব্যাংক পাড়া এই শব্দগুলো আমাদের কাছে পরিচিত মনে হলেও রেস্টুরেন্ট পাড়া শব্দটি ও কিন্তু সাম্প্রতিক বছর গুলোতে বেশ পরিচিতি পেয়েছে। এই যেমন চট্টগ্রামের কথাই ধরুন, বলা যায় চকবাজার, কাজীর দেউরি কিংবা জিইসি। ঢাকায় আছে বসুন্ধরা কিংবা পূর্বাচল ৩০০ ফিট। একই জায়গায় সল্প দুরত্বে অবস্থিত একাধিক রেস্টুরেন্ট।
আর খাবারের দাম গুলোও বেশ হাতের নাগালে হওয়ায় কলেজ ভার্সিটি পড়ুয়া তরুন তরুনী ছাড়াও বিভিন্ন বয়সের গ্রাহকদের প্রায় ই চোখে পড়ে। ফ্রেন্ডস কিংবা ফ্যামিলি নিয়ে হ্যাং আউট এর জন্যেও আজকাল রেস্টুরেন্ট একটি আকর্ষনীয় জায়গা। আর ক্লাব এর আয়োজনের ঝামেলা পোহাতে বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে আজকাল কমিউনিটি সেন্টার এর বিকল্প হিসেবে রেস্টুরেন্ট এর রয়েছে ব্যাপক চাহিদা।
দেশের অর্থনীতিতে অবদান কতটুকু?
বাংলাদেশের অর্থনীতিতে এসএমই(Small Medium Enterprise) এর অবদান মোট জিডিপি’র ২৫%। বুঝতেই পারছেন এই রেস্টুরেন্ট ব্যবসার সেক্টরটিও যেহেতু এর অন্যতম অংশগ্রহনকারী তাদের অবদান নেহাত কম নয়।
শুধু দেশেই নয় ব্রিটেনে প্রবাসী বাংলাদেশিদের দেয়া রেস্টুরেন্ট ব্যবসা থেকে বার্ষিক আয় হচ্ছে প্রায় ৪’শ কোটি পাউন্ড! বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা প্রবাসীরাও প্রবাসে রেস্টুরেন্ট প্রতিষ্ঠা করে অবদান রাখছেন রেমিট্যান্সে।
নেতিবাচক দিক এবং শেষ কথা
তবে এতসব অবদান ও ইতিবাচক কথা বলা হলেও কিছু নে্তিবাচক দিক ও রয়েছে। যেমন, যেখানে সেখানে রেস্টুরেন্ট গড়ে ওঠায় জাংক ফুড কালচার সৃষ্টি হচ্ছে যা সকল বয়সের মানুষের জন্য খুবই ক্ষতিকর। রাস্তার পাশে সৃষ্টি হচ্ছে অনাকাংক্ষিত জ্যাম।
ডার্ক রেস্টুরেন্ট এর নাম গড়ে উঠছে অনৈতিক কর্মকান্ডের আখড়া। স্কুল কলেজ গামী উঠতি বয়সের ছেলেমেয়েদের অনেকেই ক্লাস ফাঁকি দিয়ে বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিচ্ছে এই রেস্টুরেন্ট গুলোতে।
আর এটা যেহেতু খাবারের ব্যবসা তারমানে মূল পণ্যটি হলো পচনশীল। এটার কারণে বিক্রেতা এবং গ্রাহক অনেক সময় ক্ষতির সম্মুখীন হন। তবে দুই পক্ষই যদি একটু দায়িত্ববান হন তাহলে এ ধরনের ঝুঁকি হ্রাস করা সম্ভব। শুধু প্রয়োজন দুই পক্ষের সদিচ্ছা।
আর ভ্রাম্যমান আদালতের বছরব্যাপী সচল কার্যক্রম না থাকায় পচা ও বাসি খাবার পরিবেশন করা হচ্ছে অনেক রেস্টুরেন্টে। তবে কঠোর মনিটরিং এর মাধ্যমে এসকল কার্যক্রম কে যদি নিয়ন্ত্রন করা যায় এই উদীয়মান সেক্টর কে কেন্দ্র করে ই-কমার্স ও ফুড ইন্ডাস্ট্রিতে এ এগিয়ে যাওয়া বাংলাদেশ কে দেখার জন্য খুব বেশিদিন অপেক্ষা করতে হবেনা আমাদের।
আর মানুষ এখন অনলাইনমুখী হয়ে যাচ্ছে। খাবারও এর বাইরে থাকবে কেন! ঘরে বসেই যদি চাহিদা মোতাবেক খাবার পাওয়া যায় তাহলে সময় বাঁচে।
শুভকামনা রইল বাংলাদেশের সকল রেস্তোরা সত্বাধিকারীদের জন্য।
0 মন্তব্যসমূহ