উদ্যোক্তা (entrepreneur) হওয়া নাকি চাকরিজীবী হওয়া,পেশা নির্বাচন জীবনের এক গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণ। এই সিদ্ধান্ত শুধু আপনার জীবনযাত্রার পথই নির্ধারণ করে না, বরং আপনার পরিচিতিকেও আকার দেয়। তাই এই সিদ্ধান্ত কতটা গুরুত্বপূর্ণ, তা সহজেই অনুমেয়। তবে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তটি আপনাকেই নিতে হবে – ব্যবসা নাকি চাকরি? কোন পেশাটি আপনার ভবিষ্যৎ ক্যারিয়ারের জন্য অধিক সম্ভাবনাময়? উভয় পথেই সুবিধা ও অসুবিধা রয়েছে। একজন উদ্যোক্তা নিজের ব্যবসা তৈরি করতে পারে এবং নিজের মতো করে কাজ করতে পারে, যা বেশি স্বাধীনতা দেয়। তবে এতে ঝুঁকি ও চাপও বেশি থাকে। অন্যদিকে, চাকরিজীবী হওয়াটা তুলনামূলকভাবে স্থিতিশীল, বেতন নিশ্চিত এবং কর্মসংস্থান সুরক্ষিত।

অতীতে একটি ভুল ধারণা প্রচলিত ছিল যে, কম শিক্ষিত লোকেরাই ব্যবসা করে, আর শিক্ষিত মানুষেরা চাকরি খোঁজে। কিন্তু বর্তমান প্রেক্ষাপট ভিন্ন। আজকাল, বহু স্নাতক বা অধ্যয়নরত তরুণ তাদের মেধা, দক্ষতা ও উদ্ভাবনী চিন্তাভাবনাকে কাজে লাগিয়ে সফল উদ্যোক্তা হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করছেন। অন্যদিকে, অনেকেই একটি স্থিতিশীল চাকরির আশায় পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছেন। তবে বাস্তবতা হলো, বেশিরভাগ শিক্ষার্থীই তাদের ভবিষ্যৎ লক্ষ্য সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা রাখে না। তারা হয়তো পড়াশোনা করছে, কিন্তু জানে না কোন ধরনের চাকরি তারা করবে বা আদৌ কোনো চাকরি পাবে কিনা। আবার, অনেকের চাকরি খুঁজতে খুঁজতেই অনেকটা সময় পেরিয়ে যায়, কিন্তু পর্যাপ্ত সাহস ও সহায়তার অভাবে তারা উদ্যোক্তা হতে বা নিজস্ব ব্যবসা শুরু করতে দ্বিধাগ্রস্ত হন।এর একটি বড় কারণ হলো, আমাদের সমাজে এখনও অনেকেই ব্যবসাকে তেমন গুরুত্বের চোখে দেখেন না। কিন্তু প্রশ্ন হলো, সত্যিই কি তাই? নাকি ক্যারিয়ারের জন্য ব্যবস করাই অধিকতর শ্রেয়? যেখানে একটি চাকরি পাওয়ার জন্য শিক্ষার্থীরা তাদের জীবনের মূল্যবান সময় পড়াশোনার পেছনে ব্যয় করে, তবুও অনিশ্চয়তা তাদের পিছু ছাড়ে না। অনেকেই সেই সোনার হরিণ – চাকরির পেছনে ছুটেও ব্যর্থ হন। কিন্তু তারপরও তারা ঝুঁকি নিতে নারাজ, কারণ ব্যবসা বা উদ্যোক্তা হতে হলে ঝুঁকি গ্রহণ অপরিহার্য।
তাহলে আপনার গন্তব্য কোনটি? অন্যের প্রতিষ্ঠানে চাকরি করবেন, নাকি নিজেই কর্মসংস্থান সৃষ্টি করবেন? যদি নিজের ক্ষমতায়নে কাজ করতে চান, তবে আপনাকে উদ্যোক্তা হতে হবে অথবা নিজস্ব ব্যবসা শুরু করতে হবে। যারা একটু সাহসী, চ্যালেঞ্জ নিতে ভালোবাসেন এবং গতানুগতিক চিন্তাভাবনার বাইরে কিছু করার আগ্রহ রাখেন, তারা সহজেই উদ্যোক্তা হিসেবে সফল হতে পারেন। প্রবাদ আছে, "যত বড় ঝুঁকি, তত বেশি সাফল্য।" তাই উদ্যোক্তা হতে হলে বা যেকোনো ব্যবসা শুরু করতে হলে আপনাকে ঝুঁকি নিতেই হবে। আর একবার ঝুঁকি নিয়ে যাত্রা শুরু করলেই কিন্তু শেষ নয়। আপনাকে হতে হবে কঠোর পরিশ্রমী এবং বুদ্ধিমত্তার সাথে কাজ করতে হবে। তবে এখানে আপনার সম্ভাবনার দিগন্ত অসীম। সাফল্যের কোনো নির্দিষ্ট সীমা নেই। কর্মদক্ষতা ও পরিশ্রমের মাধ্যমে আপনি পৌঁছাতে পারেন অসীম উচ্চতায়, এবং এখানে আয়েরও কোনো ধরাবাঁধা নিয়ম নেই।
অন্যদিকে, চাকরি করলে আপনার আয় সীমিত ও নির্দিষ্ট থাকে। এখানে আপনার ক্যারিয়ারের অগ্রগতিও একটি নির্দিষ্ট গণ্ডির মধ্যে আবদ্ধ। তবে অনেকেই মনে করেন চাকরি মানেই একটি নিশ্চিত ভবিষ্যৎ, যেখানে মাস শেষে একটি নির্দিষ্ট অঙ্কের অর্থ পাওয়া যায় এবং জীবনযাত্রার একটা স্থিতিশীলতা থাকে। জীবনযাত্রার নিশ্চয়তা হয়তো থাকে, কিন্তু এখানে খুব বেশি উন্নতি করার সুযোগ সীমিত। আপনাকে অন্যের অধীনে কাজ করতে হয়। ঘড়ির কাঁটা ধরে অফিসে উপস্থিত হতে হয় এবং অন্যের ইচ্ছানুসারে ও অন্যের স্বপ্ন পূরণের জন্য কাজ করতে হয়। সামান্য ভুলত্রুটি হলেই চাকরি হারানোর ভয় থাকে।
তবে, আপনি যদি নিজে একজন উদ্যোক্তা হন বা আপনার নিজস্ব প্রতিষ্ঠান থাকে, তবে আপনাকে কারো কাছে কৈফিয়ত দিতে হবে না। আপনি নিজের ইচ্ছামতো অফিসে যেতে পারেন। তবে এখানে আপনার ছুটির দিন বলে কিছু থাকে না। নিজের স্বপ্ন পূরণের জন্য আপনাকে হয়তো পুরো সময় কাজ করতে হতে পারে। কারণ কাজটি আপনার নিজের জন্য, আপনার অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য। ঘুমের সময়টুকু বাদ দিলে, প্রায় সারাক্ষণই আপনার মাথায় ঘুরপাক খাবে আপনার প্রতিষ্ঠানের ভাবনা – কীভাবে ব্যবসা সম্প্রসারিত হবে, কীভাবে আয় বৃদ্ধি পাবে সেই চিন্তা।
কিন্তু চাকরিতে এই ধরনের কোনো মানসিক চাপ থাকে না। দিনের অফিস শেষ করে আপনি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে পারেন, পরিবারের সাথে সময় কাটাতে পারেন, বন্ধুদের সাথে আড্ডায় মেতে উঠতে পারেন। উপরন্তু, সাপ্তাহিক ছুটি তো আছেই। কিন্তু আপনি যদি উদ্যোক্তা হন, এই ধরনের সুযোগ আপনার জন্য প্রায় অনুপস্থিত। সর্বদা আপনাকে আপনার প্রতিষ্ঠান নিয়েই ভাবতে হবে।
তবে একজন উদ্যোক্তা হিসেবে আপনি আপনার পরবর্তী প্রজন্মের জন্য একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ ব্যবসা রেখে যেতে পারেন। কিন্তু চাকরির ক্ষেত্রে এমন কোনো সুযোগ নেই। চাকরিতে আপনার পদটি কখনোই আপনার উত্তরসূরিকে দেওয়া হবে না। তাকেও অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে নিজের পথ খুঁজে নিতে হবে।
সুতরাং, আপনি নিজেই ভেবে দেখুন – পেশা হিসেবে আপনি কোনটি চান? কোন পেশাটি আপনার ক্যারিয়ারের জন্য অধিকতর উপযোগী হবে?
0 মন্তব্যসমূহ