Header Ads Widget


 

চেকের মামলায় জেল হলেও টাকা আদায়: আইনী কাঠামো ও প্রক্রিয়া

চেক ডিজঅনার মামলায় আসামি যদি জেল খাটেও, তবুও মূল পাওনা অর্থ পরিশোধ না করে পার পাওয়ার সুযোগ নেই, যতক্ষণ না পাওনাদারের পাওনা পরিশোধ করা হয়। অন্যথায়, ব্যক্তিকে দীর্ঘকাল বা আজীবন কারাবন্দী থাকতে হতে পারে। তবে, যদি বাদীপক্ষ আসামীর বিরুদ্ধে টাকা আদায়ের জন্য পরবর্তী আইনি পদক্ষেপ না নেন, সেক্ষেত্রে আসামী জেল এবং টাকা আদায়ের উভয় দিক থেকে রেহাই পেতে পারেন।

চেকের মামলা

টাকা আদায়ে বাদীপক্ষের আইনি পদক্ষেপ:

যে আদালত চেক ডিজঅনারের মামলায় আসামীকে কারাদণ্ড দিয়েছেন, সেই একই আদালতে বাদীপক্ষ অর্থাৎ পাওনাদার ফৌজদারী কার্যবিধির ৩৮৬ ধারার বিধান অনুযায়ী টাকা আদায়ের জন্য পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণের আবেদন করতে পারেন।

ফৌজদারী কার্যবিধির ৩৮৬ (১) (বি) ধারানুসারে, আদালত টাকা আদায়ের লক্ষ্যে 'লেভি ওয়ারেন্ট' ইস্যু করবেন এবং সেটি কার্যকর করার জন্য সংশ্লিষ্ট জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের (ডিসি সাহেব) কাছে প্রেরণ করবেন।

জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের ভূমিকা ও সম্পত্তি ক্রোক-বিক্রয়:

জেলা ম্যাজিস্ট্রেট উক্ত লেভি ওয়ারেন্টের ভিত্তিতে দায়িক অর্থাৎ আসামীর স্থাবর সম্পত্তি ক্রোক ও বিক্রয়ের প্রক্রিয়া শুরু করবেন। ওয়ারেন্টে উল্লিখিত সম্পত্তি ক্রোক ও বিক্রয়ের উদ্যোগ নেওয়া হবে।

যদি জেলা ম্যাজিস্ট্রেট জানতে পারেন যে, আসামী পূর্বে উক্ত স্থাবর সম্পত্তি বিক্রি বা বন্ধক রেখেছেন, তবে তিনি সেই কার্যক্রম স্থগিত রাখবেন। এক্ষেত্রে, তিনি পাওনাদারকে আসামীর অন্য কোনো স্থাবর বা অস্থাবর সম্পত্তির সন্ধান দিতে নির্দেশ দেবেন। যদি আসামীর অন্য কোনো সম্পত্তি পাওয়া যায়, তবে সেটি ক্রোক ও বিক্রয় করে পাওনাদারের টাকা আদায়ের ব্যবস্থা করা হবে।

সম্পত্তি হস্তান্তরের ক্ষেত্রে বিবেচ্য বিষয়:

এখানে বিশেষভাবে খেয়াল রাখতে হবে যে, যদি আসামী মামলা দায়ের হওয়ার আগেই কোনো সম্পত্তি বিক্রি করে থাকেন, তবে সেই ক্রেতার স্বার্থে কোনো প্রকার হস্তক্ষেপ করা যাবে না। তবে, চেক মামলার কার্যক্রম চলাকালীন সময়ে যদি আসামী পাওনাদারকে বঞ্চিত করার উদ্দেশ্যে কোনো জমি হস্তান্তর করেন, সেক্ষেত্রে কিন্তু লেভি ওয়ারেন্টের কার্যক্রম বন্ধ রাখা যাবে না। কারণ, তখন ধরে নেওয়া হবে যে, আসামী তার নিকট প্রাপ্য টাকা যাতে আদায় করা না যায়, সেই উদ্দেশ্যে কৌশলে এই হস্তান্তর করেছেন।

লেভি ওয়ারেন্ট ও দেওয়ানী আদালতের ডিক্রি:

উল্লেখ্য, ফৌজদারী কার্যবিধির ৩৮৬ (১) (বি) ধারা অনুযায়ী জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে প্রেরিত লেভি ওয়ারেন্ট মূলত দেওয়ানী আদালতের ডিক্রির মতোই গণ্য হয়। দেওয়ানী আদালতে যেভাবে ডিক্রি কার্যকর করা হয়, একই পদ্ধতিতে এই লেভি ওয়ারেন্টও কার্যকর করা যাবে।

সরকারি দাবি হিসেবে গণ্য ও আদায় প্রক্রিয়া:

আরও উল্লেখ্য যে, জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে লেভি ওয়ারেন্ট পৌঁছানোর পর সেটি সরকারি দাবি হিসেবে বিবেচিত হবে। এই দাবি আদায়ের জন্য জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ১৯১৩ সালের সরকারি দাবি আদায় আইনের বিধান অনুসরণ করবেন।

সরকারি দাবি আদায় আইনের ১৪ ধারার বিধান অনুযায়ী, সার্টিফিকেট অফিসার নিম্নলিখিত পদ্ধতিগুলোর মাধ্যমে টাকা আদায় করতে পারবেন:

  • সম্পত্তি ক্রোক ও বিক্রয় অথবা বিনা ক্রোকে বিক্রয় করা।
  • যেকোনো ডিক্রি ক্রোক করা।
  • সার্টিফিকেট দেনদারকে গ্রেফতার করা।
  • উপরোক্ত যেকোনো একটি বা একাধিক পদ্ধতি প্রয়োগ করা।

যদি দেনাদারের কোনো সম্পত্তি না থাকে, তবে সরকারি দাবি আদায় আইনের ১৪ ধারার বিধান অনুসরণ করে দেনাদারকে দেওয়ানী কয়েদে আটক রেখে টাকা আদায়ের ব্যবস্থা করা হবে।

উচ্চ আদালতের একটি গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণ:

বিষয়টি আরও স্পষ্ট করার জন্য একটি উচ্চ আদালতের মামলার উদাহরণ উপস্থাপন করা হলো:

পাবনার জেলা প্রশাসক ১৯৯০ সালে বেড়া উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যানের কাছে দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্তদের ত্রাণ বিতরণের জন্য ২০০ মেট্রিক টন চাল বরাদ্দ করেন। পরবর্তীতে, বেড়া উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান একই উদ্দেশ্যে উক্ত চাল থেকে ২০ মেট্রিক টন চাল বেড়া পৌরসভার কমিশনার আসামী রওশন আলীর কাছে বরাদ্দ করেন। রওশন আলী এই শর্তে চাল গ্রহণ করেন যে, তিনি মাস্টার রোলের ভিত্তিতে ত্রাণ কর্মকর্তার সামনে ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে তা বিতরণ করবেন এবং বিতরণের একদিনের মধ্যে মাস্টার রোল উপজেলা পরিষদে জমা দেবেন।

কিন্তু আসামী ১,৯৬,৮০০.০০/- টাকা মূল্যের ২০ মেট্রিক টন চাল বিতরণ না করে আত্মসাৎ করেন। এই অভিযোগে তার বিরুদ্ধে দণ্ডবিধির ৪০৯ ধারা এবং দুর্নীতি দমন বিভাগের ১৯৪৭ সালের ২নং আইনের ৫(২) ধারায় অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়।

বিভাগীয় বিশেষ বিচারকের আদালতে আসামী অভিযুক্ত হলে, তিনি অভিযোগ অস্বীকার করেন। বিচারক ১২ জন সাক্ষীর সাক্ষ্য ও দলিলপত্র বিবেচনা করে আসামীকে দণ্ডবিধির ৪০৯ ও ১৯৪৭ সালের ২নং আইনের ৫(২) ধারায় দোষী সাব্যস্ত করে ৩ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড এবং ১,৯৬,৮০০.০০/- টাকা জরিমানা অনাদায়ে আরও ৬ মাসের সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত করেন।

এই রায়ের বিরুদ্ধে আসামী হাইকোর্ট বিভাগে আপিল করলে, হাইকোর্ট আপিল খারিজ করে দেন এবং বিভাগীয় বিশেষ বিচারককে জরিমানার ১,৯৬,৮০০.০০/- টাকা আপিলকারীর কাছ থেকে আদায় করার নির্দেশ দেন। (মোঃ রওশন আলী বনাম রাষ্ট্র, ২০০২ বি.এল.ডি. পৃষ্ঠা ৩৩)

জরিমানা আর্থিক দণ্ড, কারাদণ্ড বিকল্প নয়:

এই উদাহরণ থেকে স্পষ্টভাবে বোঝা যায় যে, ফৌজদারি আদালত কর্তৃক আসামীর উপর আরোপিত জরিমানা শারীরিক দণ্ডের পরিবর্তে একটি আর্থিক দণ্ড। এক্ষেত্রে, আসামী জরিমানা পরিশোধ না করে শুধুমাত্র কারাদণ্ড ভোগ করে এই আর্থিক দায় থেকে মুক্তি পেতে পারে না। ফৌজদারি কার্যবিধির ৩৮৬ ধারার বিধান অনুযায়ী, জরিমানা দেওয়ানী আদালতের ডিক্রির মতো একটি অবশ্য পরিশোধযোগ্য আদেশ। যদি আসামিকে জরিমানা পরিশোধের ব্যর্থতায় স্বেচ্ছায় কারাদণ্ড ভোগের সুযোগ দেওয়া হয়, তবে জরিমানার মূল উদ্দেশ্যই ব্যাহত হবে।

ফৌজদারি আদালত কর্তৃক আরোপিত জরিমানা যেহেতু একটি আর্থিক দণ্ড, তাই তা সরকারি পাওনা হিসেবে ফৌজদারি কার্যবিধির ৩৮৬ ধারার বিধান ও পদ্ধতি অনুসরণ করে আদায় করতে হবে। দুর্নীতির মামলায় আসামিকে তছরূপকৃত অর্থের সমপরিমাণ জরিমানা করার উদ্দেশ্য হলো রাষ্ট্রীয় ক্ষতির পূরণ করা। যদি এটি আদায় করা না যায়, তবে অপরাধীরা একই ধরনের অপরাধ করতে উৎসাহিত হবে।

এইভাবে, জরিমানা সরকারের পাওনা হিসেবে দণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তির সম্পদের উপর একটি দায় এবং এটি তার মৃত্যুর পরেও আদায়যোগ্য। শুধুমাত্র সেই ক্ষেত্রেই দণ্ডিত ব্যক্তিকে জরিমানার পরিবর্তে কারাদণ্ড ভোগ করতে হয়, যখন তার সম্পদের মাধ্যমে জরিমানা পরিশোধ করা সম্ভব নয়।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ