Header Ads Widget


 

মফস্বল উদ্যোক্তাদের সামনে সমস্যার পাহাড়, তবুও আশার আলো

মফস্বল অর্থাৎ শহরের বাইরের ছোট ছোট গ্রাম বা উপজেলা পর্যায়ের এলাকা। এই অঞ্চলগুলোর অর্থনৈতিক চেহারা এখন ধীরে ধীরে বদলে যাচ্ছে। দিন দিন বাড়ছে ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তার সংখ্যা, যারা নিজেরাই নিজেদের ভাগ্য গড়ার স্বপ্ন দেখছেন। তবে শহরের তুলনায় মফস্বলে ব্যবসা শুরু করা এবং তা পরিচালনা করা সহজ কাজ নয়। অবকাঠামোগত দুর্বলতা, বিনিয়োগের সংকট, প্রযুক্তিগত দুর্বলতা ও সচেতনতার অভাব। এসব চ্যালেঞ্জ পেরিয়ে এগিয়ে যেতে হচ্ছে এই উদ্যোক্তাদের।

মফস্বল উদ্যোক্তা

তাদের এই যাত্রা কেবল ব্যক্তিগত স্বপ্ন পূরণের নয়, বরং দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের সাথেও ওতপ্রোতভাবে জড়িত। তাই মফস্বল উদ্যোক্তাদের সমস্যাগুলো চিহ্নিত করা এবং সম্ভাবনাগুলো কাজে লাগাতে যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া সময়ের দাবি। এই প্রতিবেদনে আমরা তুলে ধরব মফস্বল উদ্যোক্তাদের প্রধান সমস্যা, তাদের বাস্তব চ্যালেঞ্জ, তাদের মধ্যে বিদ্যমান সম্ভাবনাগুলো তুলে ধরা হলো।

মফস্বল উদ্যোক্তাদের প্রধান সমস্যা:

১. মূলধনের অভাব: মফস্বলের অধিকাংশ উদ্যোক্তারই পর্যাপ্ত মূলধনের অভাব থাকে। ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ পাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে, যা তাদের ব্যবসার সম্প্রসারণ এবং নতুন উদ্যোগ শুরু করার ক্ষেত্রে প্রধান বাধা।

২. অবকাঠামোগত দুর্বলতা: উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা, বিদ্যুৎ সরবরাহ, এবং পয়ঃনিষ্কাশনের অভাব মফস্বলের ব্যবসার জন্য একটি বড় সমস্যা। কাঁচামাল পরিবহন, উৎপাদিত পণ্য বাজারে নিয়ে যাওয়া এবং আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের ক্ষেত্রে এটি প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে।

৩. প্রশিক্ষণ ও দক্ষতার অভাব: অনেক মফস্বল উদ্যোক্তার আধুনিক ব্যবসা ব্যবস্থাপনা, প্রযুক্তি ব্যবহার এবং বাজারজাতকরণ সম্পর্কে পর্যাপ্ত জ্ঞান ও দক্ষতার অভাব রয়েছে। উপযুক্ত প্রশিক্ষণের অভাবে তারা প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে থাকেন।

৪. বাজারের অভাব ও সীমিত চাহিদা: মফস্বলের বাজার সাধারণত ছোট এবং চাহিদা সীমিত থাকে। ফলে, উৎপাদিত পণ্যের একটি বড় অংশ বিক্রি করা কঠিন হয়ে পড়ে। অন্যদিকে, বৃহত্তর বাজারের সাথে সংযোগের অভাবও একটি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা।

৫. প্রযুক্তির অভাব: আধুনিক যন্ত্রপাতি ও প্রযুক্তির ব্যবহার মফস্বলে তুলনামূলকভাবে কম। এর ফলে উৎপাদনশীলতা কম হয় এবং পণ্যের গুণগত মান বজায় রাখা কঠিন হয়ে পড়ে।

৬. সরকারি সহায়তার অভাব: মফস্বলের উদ্যোক্তারা প্রায়শই সরকারি প্রণোদনা, নীতিগত সহায়তা এবং তথ্য প্রাপ্তির ক্ষেত্রে পিছিয়ে থাকেন।

৭. সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বাধা: কিছু ক্ষেত্রে সামাজিক রীতিনীতি এবং সাংস্কৃতিক ধারণা উদ্যোক্তা হওয়ার ক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টি করতে পারে, বিশেষ করে নারী উদ্যোক্তাদের জন্য এটি আরও প্রকট।

মফস্বল উদ্যোক্তাদের সম্ভাবনা:

১. স্থানীয় সম্পদের প্রাচুর্য: মফস্বলে কৃষি, মৎস্য, বনজ সম্পদ এবং হস্তশিল্পের মতো স্থানীয় সম্পদের প্রাচুর্য রয়েছে। উদ্যোক্তারা এসব সম্পদ ব্যবহার করে নতুন নতুন পণ্য ও সেবা তৈরি করতে পারেন।

২. কম উৎপাদন খরচ: শহরাঞ্চলের তুলনায় মফস্বলে জমি, শ্রম এবং অন্যান্য সম্পদের খরচ তুলনামূলকভাবে কম। এর ফলে উৎপাদন খরচ কমিয়ে পণ্যের প্রতিযোগিতামূলক মূল্য নির্ধারণ করা যেতে পারে।

৩. স্থানীয় বাজারের চাহিদা: স্থানীয় বাজারের চাহিদা পূরণের বিশাল সুযোগ রয়েছে। কৃষি প্রক্রিয়াকরণ, হস্তশিল্প, স্থানীয় পর্যটন এবং অন্যান্য সেবাভিত্তিক ব্যবসা এক্ষেত্রে সম্ভাবনাময়।

৪. তরুণ প্রজন্মের আগ্রহ: বর্তমানে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে উদ্যোক্তা হওয়ার আগ্রহ দেখা যাচ্ছে। সঠিক দিকনির্দেশনা ও সুযোগ পেলে তারা মফস্বলের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।

৫. তথ্য প্রযুক্তির প্রসার: তথ্য প্রযুক্তির প্রসারের ফলে মফস্বলের উদ্যোক্তারা এখন বৃহত্তর বাজারের সাথে যুক্ত হওয়ার সুযোগ পাচ্ছেন। অনলাইন প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে তারা তাদের পণ্য ও সেবা দেশব্যাপী ছড়িয়ে দিতে পারেন।

৬. সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগ: সরকার এবং বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা মফস্বলের উদ্যোক্তাদের উন্নয়নে বিভিন্ন সহায়তা ও প্রশিক্ষণ কর্মসূচি পরিচালনা করছে। এই উদ্যোগগুলো উদ্যোক্তাদের জন্য নতুন সম্ভাবনা তৈরি করছে।

৭. কৃষিভিত্তিক শিল্পের সম্ভাবনা: কৃষি প্রধান অঞ্চল হওয়ায় মফস্বলে কৃষি প্রক্রিয়াকরণ শিল্প, খাদ্য উৎপাদন এবং কৃষি সরঞ্জাম তৈরির ব্যবসার অপার সম্ভাবনা রয়েছে।

৮. পর্যটন শিল্পের বিকাশ: অনেক মফস্বল অঞ্চলে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও ঐতিহাসিক স্থান বিদ্যমান। পরিকল্পিত উপায়ে পর্যটন শিল্পের বিকাশের মাধ্যমে স্থানীয় উদ্যোক্তারা নতুন আয়ের উৎস তৈরি করতে পারেন।

সম্ভাবনা বাস্তবায়নের জন্য সুপারিশ:

     * মফস্বলের উদ্যোক্তাদের জন্য সহজ শর্তে ঋণ ও আর্থিক সহায়তা প্রদান করা।

    * অবকাঠামোগত উন্নয়নে বিশেষ নজর দেওয়া, যেমন - উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা, বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করা।

    * আধুনিক ব্যবসা ব্যবস্থাপনা, প্রযুক্তি ব্যবহার ও বাজারজাতকরণের উপর প্রশিক্ষণ কর্মসূচি চালু করা।

    * স্থানীয় বাজারের পাশাপাশি বৃহত্তর বাজারের সাথে সংযোগ স্থাপনের জন্য সহায়তা করা।

    * তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহারের সুবিধা এবং প্রশিক্ষণ প্রদান করা।

    * সরকারি নীতি ও সহায়তার বিষয়ে মফস্বলের উদ্যোক্তাদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করা।

    * নারী উদ্যোক্তাদের জন্য বিশেষ সহায়তা ও সুযোগ তৈরি করা।

মফস্বল উদ্যোক্তাদের সমস্যা যতই প্রকট হোক না কেন, আশার আলোও রয়েছে সমানভাবে। তাদের সম্ভাবনাকে পুরোপুরি কাজে লাগাতে হলে সঠিক দিকনির্দেশনা,  প্রশিক্ষণ, প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহার, আর্থিক সহায়তা বৃদ্ধি, অবকাঠামোগত উন্নয়ন, দক্ষতা বৃদ্ধি এবং ভবিষ্যতের জন্য তাদের পাশে দাঁড়ানো, সুযোগ সৃষ্টি করা জরুরি। সরকার, বেসরকারি সংস্থা এবং স্থানীয় সম্প্রদায়ের সহযোগিতার মাধ্যমে মফস্বলের উদ্যোক্তারা শুধু স্থানীয় অর্থনীতিতেই নয়, জাতীয় অর্থনীতিতে আরও শক্তিশালী ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবেন। এখনই সময় তাদের পাশে দাঁড়ানোর।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ