Header Ads Widget


 

শেষ নেই : ভাবনায় পথ চলা - এম এস হাবিবুর রহমান

বর্তমান বিশ্বে উদ্যোক্তা হওয়া মানে শুধু ব্যবসা নয়, বরং সমাজে ন্যায়ভিত্তিক দৃষ্টান্ত স্থাপন জীবনদর্শন এবং চ্যালেঞ্জিং পথ। আর এই জীবনদর্শন যদি ইসলামি মূল্যবোধ এবং আধুনিক বিজনেস জ্ঞানের উপর ভিত্তি করে পরিচালিত হয়, তাহলে তা কেবল দুনিয়ার সফলতাই নয়, আখিরাতের মুক্তির পথও হতে পারে। উদ্যোক্তা হওয়ার আগে প্রয়োজন বিশ্বাসের ভিত্তি। একজন উদ্যোক্তার পথচলা কোনো নির্দিষ্ট গন্তব্যে থেমে থাকে না। এটি একটানা চলমান একটি প্রক্রিয়া, যেখানে প্রতিটি পদক্ষেপে থাকে চিন্তা, পরিকল্পনা, পরিবর্তন একটানা ভাবনায় পথ চলা; এর কোনো শেষ নেই। একজন মুসলিম উদ্যোক্তার এই দৃষ্টিভঙ্গিই বিজনেস আত্মিক উন্নয়ন এবং আখিরাতে মুক্তির শ্রেষ্ঠ সূত্র।

entrepreneur

একজন উদ্যোক্তার জীবন সত্যিই এক অন্তহীন পথচলার মতো। ইসলামিক মূল্যবোধ এবং আধুনিক ব্যবসায়িক চিন্তাভাবনার সমন্বয়ে একজন উদ্যোক্তা কেবল সফলতাই অর্জন করতে পারেন না, বরং একটি নৈতিক কল্যাণমুখী সমাজ, রাষ্ট ও বিশ্ব গঠনেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। সততা, ন্যায়পরায়ণতা এবং আল্লাহর উপর ভরসা রেখে অবিচলভাবে লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে যাওয়াই একজন মুসলিম উদ্যোক্তার মূলমন্ত্র হওয়া উচিত বলে মনে করি। আমি এই বইটিতে নতুন উদ্যোক্তাদের জন্য একটি দিকনির্দেশনা দিতে চেষ্টা করছি যা তাদের সফলতার পথে সহায়ক হবে বলে প্রত্যাশা রাখি।

ইসলামের দৃষ্টিতে উদ্যোক্তা:

ইসলাম সর্বদা হালাল উপায়ে জীবিকা অর্জনের ওপর গুরুত্ব আরোপ করে। ব্যবসা-বাণিজ্যকে ইসলামে উৎসাহিত করা হয়েছে, তবে তা অবশ্যই শরীয়াহর নীতিমালার আলোকে পরিচালিত হতে হবে। একজন মুসলিম উদ্যোক্তার মূলনীতি হওয়া উচিত সততা, ন্যায়পরায়ণতা এবং অন্যের অধিকারের প্রতি সম্মান প্রদর্শন।


* হালাল উপার্জন: ইসলামে হারাম পন্থায় উপার্জন কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। একজন উদ্যোক্তাকে অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে তার ব্যবসার প্রতিটি প্রক্রিয়া শরীয়াহসম্মত।
* সততা ও আমানতদারী: লেনদেন এবং গ্রাহকদের সাথে ব্যবহারে সততা ও বিশ্বাসযোগ্যতা অপরিহার্য। ওয়াদা রক্ষা করা এবং কোনো প্রকার ধোঁকাবাজি থেকে দূরে থাকা একজন মুসলিম উদ্যোক্তার বৈশিষ্ট্য।
* ন্যায়বিচার: ব্যবসা পরিচালনার ক্ষেত্রে পক্ষপাতদুষ্টতা পরিহার করে সকলের সাথে ন্যায়সঙ্গত আচরণ করতে হবে। শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরি প্রদান এবং তাদের অধিকার রক্ষা করা জরুরি।
* সামাজিক দায়বদ্ধতা: ইসলাম কেবল ব্যক্তিগত লাভের ওপর জোর দেয় না, বরং সমাজের প্রতিও দায়িত্ব পালনের কথা বলে। যাকাত প্রদান এবং দরিদ্র ও অসহায়দের সাহায্য করার মাধ্যমে একজন উদ্যোক্তা তার সামাজিক দায়বদ্ধতা পালন করতে পারে।
* ঝুঁকি গ্রহণ ও আল্লাহর উপর ভরসা: ইসলামে হালাল উপায়ে ঝুঁকি গ্রহণের অবকাশ রয়েছে। তবে এক্ষেত্রে আল্লাহর উপর পূর্ণ ভরসা (তাওয়াক্কুল) রাখা এবং ধৈর্য ধারণ করা জরুরি।

আধুনিক ব্যবসায়িক চিন্তাভাবনা:

ইসলামিক মূল্যবোধের পাশাপাশি একজন সফল উদ্যোক্তাকে আধুনিক ব্যবসায়িক কৌশল এবং ধারণাও আয়ত্ত করতে হবে।

* উদ্ভাবনী ধারণা: বাজারের চাহিদা এবং সমস্যা চিহ্নিত করে নতুন ও কার্যকর সমাধান নিয়ে আসা একজন উদ্যোক্তার প্রধান কাজ। নিয়মিত গবেষণা এবং সৃজনশীল চিন্তাভাবনার মাধ্যমে উদ্ভাবনী ধারণা তৈরি করা সম্ভব।
* ব্যবসায়িক পরিকল্পনা: একটি সুস্পষ্ট ব্যবসায়িক পরিকল্পনা ব্যবসার দিকনির্দেশনা দেয়। এতে ব্যবসার লক্ষ্য, কৌশল, বাজার বিশ্লেষণ, আর্থিক পরিকল্পনা এবং ঝুঁকি মোকাবিলার উপায় উল্লেখ থাকে।
* বাজার গবেষণা: বাজারে প্রবেশ করার আগে টার্গেট গ্রাহক এবং প্রতিযোগীদের সম্পর্কে বিস্তারিত জ্ঞান থাকা আবশ্যক। বাজার গবেষণার মাধ্যমে গ্রাহকের চাহিদা, পছন্দ এবং বাজারের ট্রেন্ড সম্পর্কে ধারণা লাভ করা যায়।
* আর্থিক ব্যবস্থাপনা: ব্যবসার আর্থিক দিকটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাজেট তৈরি করা, আয়-ব্যয়ের হিসাব রাখা, বিনিয়োগের সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়া এবং অর্থের সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিত করা অপরিহার্য।
* বিপণন ও বিক্রয়: পণ্যের বা সেবার প্রচার এবং গ্রাহকদের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য কার্যকর বিপণন কৌশল অবলম্বন করতে হবে। আধুনিক ডিজিটাল মার্কেটিং এবং ঐতিহ্যবাহী পদ্ধতির সঠিক সমন্বয় প্রয়োজন।
* কার্যক্রম ও ব্যবস্থাপনা: ব্যবসার দৈনন্দিন কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য দক্ষ ব্যবস্থাপনা প্রয়োজন। কর্মী নিয়োগ, প্রশিক্ষণ এবং তাদের কাজের পরিবেশ উন্নত রাখা ব্যবসার সাফল্যের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
* আইন ও নীতিশাস্ত্র: ব্যবসার সাথে সম্পর্কিত সকল আইনকানুন সম্পর্কে অবগত থাকা এবং নৈতিক নীতিমালা মেনে চলা জরুরি। গ্রাহকদের অধিকার রক্ষা করা এবং পরিবেশের প্রতি সচেতন থাকা আবশ্যক।
* প্রযুক্তি ও উদ্ভাবন: আধুনিক যুগে প্রযুক্তি ব্যবসার একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। নতুন প্রযুক্তির ব্যবহার এবং ব্যবসায়িক প্রক্রিয়ায় উদ্ভাবন আনা প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার জন্য অপরিহার্য।
* যোগাযোগ ও সহযোগিতা: গ্রাহক, সরবরাহকারী, বিনিয়োগকারী এবং কর্মীদের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখা ব্যবসার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। পারস্পরিক সহযোগিতা এবং যোগাযোগের মাধ্যমে ব্যবসার প্রসার ঘটানো সম্ভব।

ইসলামিক মূল্যবোধ আধুনিক ব্যবসার সমন্বয়:

একজন মুসলিম উদ্যোক্তা তার ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ডে ইসলামিক মূল্যবোধকে কিভাবে প্রয়োগ করবেন?

* সিদ্ধান্ত গ্রহণ: প্রতিটি ব্যবসায়িক সিদ্ধান্ত শরীয়াহর আলোকে গ্রহণ করতে হবে। কোনো প্রকার হারাম লেনদেন বা অনৈতিক কার্যকলাপ থেকে দূরে থাকতে হবে।
* গ্রাহক সম্পর্ক: গ্রাহকদের সাথে সম্মানজনক আচরণ করতে হবে এবং তাদের অধিকার রক্ষা করতে হবে। মিথ্যা প্রতিশ্রুতি বা ভেজাল পণ্য বিক্রি করা ইসলামে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ।
* কর্মী ব্যবস্থাপনা: কর্মীদের সাথে ন্যায্য আচরণ করতে হবে এবং তাদের প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা প্রদান করতে হবে। তাদের ধর্মীয় ও ব্যক্তিগত জীবনে সম্মান জানানো একজন মুসলিম উদ্যোক্তার কর্তব্য।
* প্রতিযোগী মনোভাব: সুস্থ প্রতিযোগিতাকে ইসলামে উৎসাহিত করা হয়, তবে বিদ্বেষপূর্ণ বা অনৈতিক প্রতিযোগিতা পরিহার করা উচিত। অন্যের সাফল্যে ঈর্ষান্বিত না হয়ে নিজের উন্নতিতে মনোযোগ দেওয়া উচিত।
* মুনাফা ও কল্যাণ: ব্যবসার মূল লক্ষ্য মুনাফা অর্জন হলেও, তা যেন সমাজের বৃহত্তর কল্যাণের পরিপন্থী না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। ব্যবসার মাধ্যমে কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং মানুষের জীবনযাত্রার মানোন্নয়নে ভূমিকা রাখা একজন মুসলিম উদ্যোক্তার নৈতিক দায়িত্ব।
* ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা: ইসলামে অতিরিক্ত ঝুঁকি নেওয়া অনুচিত। ব্যবসার ঝুঁকি সঠিকভাবে মূল্যায়ন করতে হবে এবং তা মোকাবিলার জন্য পূর্ব প্রস্তুতি নিতে হবে।

উদ্যোক্তা হওয়ার পথে পদক্ষেপ:

* আত্ম-বিশ্লেষণ: নিজের আগ্রহ, দক্ষতা এবং দুর্বলতা সম্পর্কে ভালোভাবে জানতে হবে। কোন ধরনের ব্যবসা আপনার জন্য উপযুক্ত তা নির্ধারণ করতে হবে।
* জ্ঞান অর্জন: ব্যবসা এবং শিল্প সম্পর্কিত প্রয়োজনীয় জ্ঞান অর্জন করতে হবে। বিভিন্ন কোর্স, সেমিনার এবং অভিজ্ঞদের পরামর্শ এক্ষেত্রে সহায়ক হতে পারে।
* ধারণা নির্বাচন ও যাচাই: একাধিক ব্যবসায়িক ধারণা নিয়ে চিন্তা করতে হবে এবং বাজার চাহিদার ভিত্তিতে সবচেয়ে সম্ভাবনাময় ধারণাটি নির্বাচন করতে হবে।
* ব্যবসায়িক পরিকল্পনা তৈরি: একটি বিস্তারিত ব্যবসায়িক পরিকল্পনা তৈরি করতে হবে, যেখানে ব্যবসার লক্ষ্য, কৌশল, বাজার বিশ্লেষণ, আর্থিক পরিকল্পনা ইত্যাদি উল্লেখ থাকবে।
* অর্থায়ন: ব্যবসার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থায়নের উৎস নির্ধারণ করতে হবে। ব্যক্তিগত সঞ্চয়, ঋণ অথবা বিনিয়োগকারীর সন্ধান করতে হতে পারে।
* আইনি প্রক্রিয়া সম্পন্ন: ব্যবসার নিবন্ধন এবং অন্যান্য আইনি প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে হবে।
* কার্যক্রম শুরু: পরিকল্পনা অনুযায়ী ব্যবসার কার্যক্রম শুরু করতে হবে।
* বিপণন ও বিক্রয়: কার্যকর বিপণন কৌশলের মাধ্যমে গ্রাহকদের কাছে পণ্য বা সেবা পৌঁছে দিতে হবে।
* ব্যবস্থাপনা ও পরিচালনা: ব্যবসার দৈনন্দিন কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করতে হবে।
* পর্যালোচনা ও উন্নয়ন: নিয়মিত ব্যবসার অগ্রগতি পর্যালোচনা করতে হবে এবং প্রয়োজনে পরিবর্তন ও উন্নয়ন ঘটাতে হবে।

চ্যালেঞ্জ উত্তরণের উপায়:

উদ্যোক্তা হওয়ার পথে অনেক চ্যালেঞ্জ আসতে পারে। আর্থিক সংকট, বাজারের প্রতিযোগিতা, প্রযুক্তিগত পরিবর্তন এবং অপ্রত্যাশিত পরিস্থিতি মোকাবিলা করার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। ধৈর্য, অধ্যবসায় এবং সঠিক পরিকল্পনার মাধ্যমে এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা সম্ভব। আল্লাহর উপর ভরসা রাখা এবং হতাশ না হয়ে চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া একজন উদ্যোক্তার জন্য অপরিহার্য।

এম এস হাবিবুর রহমান এর লেখা ’দ্য ফাইনাল বিজনেস রেইস’ বই থেকে নেয়া।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ