গবেষণা ও উন্নয়নমূলক প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ রিসোর্স সেন্টার ফর ইন্ডিজিনাস নলেজ-বারসিকের ২০২২ সালে ‘কৃষিজমির সংকট রূপ এবং সমাধানে করণীয়বিষয়ক মাঠ সমীক্ষায় দেখা যায়, বরেন্দ্র অঞ্চলের কৃষক বৈচিত্র্যময় ফসল চাষ করতে পারছেন না। খরার কারণে অনাবাদি বা অকৃষিজমির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪৫ শতাংশ। প্রতিবেদনে দেখা যায়, খরা ও পানির অভাবসহ বিভিন্ন কারণে ১৯৭১ সালের পর থেকেই ৭০ শতাংশ প্রান্তিক কৃষক তার নিজের চাষের জমি হারিয়েছে। খরার প্রভাব খুব গভীরে, নীরব ঘাতকের মতো নিঃশেষ করছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশে বন্যা কিংবা ঘূর্ণিঝড় নিয়ে যতটা আলোচনার ঝড় ওঠে, খরা নিয়ে ততটা গভীর আলোচনায় আমরা পৌঁছাতে পারিনি এখনো। অথচ দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোর দিকে তাকালে স্পষ্ট দেখা যায়— খরার ভয়াবহতা শুধু ফসলের ক্ষতি করে না, মানুষের জীবনযাত্রা, খাদ্যনিরাপত্তা, স্বাস্থ্য ও আর্থসামাজিক কাঠামোকেও ক্ষতবিক্ষত করে দিচ্ছে। খরায় আক্রান্ত প্রান্তিক মানুষের ক্ষতির খবরগুলো খুব কমই আসে জাতীয় আলোচনায়।
খরাপ্রবণ বরেন্দ্র অঞ্চলের রাজশাহীর তানোর উপজেলার সুজলা মার্ডির ৬০ হাজার টাকার ষাঁড় গরু মারা গেছে। আঙ্গুরি বেগমের তিনটি ছাগল মারা গেছে। কৃষকের ফসল পুড়ে যায় খরায়– এ রকম অনেক ঘটনাই ঘটছে খরাপ্রবণ বরেন্দ্র অঞ্চলের গ্রামগুলোতে। তারা কোনো ক্ষতিপূরণ পায় না এবং পায়নি। বরেন্দ্র অঞ্চলে খরা ও পানিহীনতার কারণে মানুষ মারা গেছে, সহিংসতা বাড়ছে বরেন্দ্র অঞ্চলের সমাজে। পানিহীনতা ও ভূগর্ভে পানিশূন্যতা, প্রান্তিক মানুষের পানির অধিকারই শুধু নয়; এই পানির অধিকারহীনতায় ভুগছে এই অঞ্চলের প্রাণবৈচিত্র্য পরিবেশ। পরিবেশ তার নিজের অবস্থানে ভালো থাকার অধিকার আছে। এর সবই ঘটছে মূলত খরা ও পানির অভাবের কারণে। এ রকম বহু ঘটনা, দুর্ঘটনা ঘটছে বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল অবস্থিত খরাপ্রবণ বরেন্দ্র অঞ্চলে।
দেশের এক-দশমাংশ অঞ্চল নিয়ে গঠিত পার্বত্য চট্টগ্রাম। প্রকৃতিগতভাবে তিন পার্বত্য জেলার প্রান্তিক মানুষের সুপেয় পানির জোগান দিত পাহাড়ের ঝিরি-ঝরনা ও ছড়াগুলো। প্রাকৃতিক উৎসের অফুরন্ত পানিকে কেন্দ্র করে মুখর ছিল পাহাড়ের জনজীবন। তবে কয়েক বছর ধরে চিত্র ভিন্ন। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন জেলা রাঙ্গামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়িতে পানির তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। ছড়া ও ঝিরি-ঝরনাগুলোয় বছরের বেশির ভাগ সময়ই পানি পাওয়া যাচ্ছে না। পাহাড়ের প্রান্তিক মানুষ সুপেয় ও ব্যবহার্য পানির সংকটে ভুগছে। বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে এ তিন জেলার জনজীবন। এমনকি তীব্র তাপপ্রবাহে পুড়ে যাচ্ছে খেতের ফসল। তীব্র তাপপ্রবাহ এবং পানির সংকটে কৃষিকাজ ও উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। সব মিলিয়ে পার্বত্য অঞ্চলে সুপেয় পানির সংকটে বিপাকে পড়েছে সাধারণ মানুষ।
জলবায়ু পরিবর্তনজনিত অভিঘাতে সমুদ্রের উচ্চতা বৃদ্ধি পেয়ে শুধু নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হচ্ছে তা নয় খরার কারণে লবণাক্ততা বৃদ্ধিসহ চাষাবাদ ব্যাহত হওয়ার পাশাপাশি মানুষের জীবনযাপনও কঠিন হয়ে পড়ছে। সে সঙ্গে উদ্ভিদ ও জীববৈচিত্র্যকে হুমকির মুখে ফেলেছে। কাজেই আগামীর সকল পরিকল্পনায় পানির সংকটকে প্রাধান্য দিতে হবে।
0 মন্তব্যসমূহ